২০১৫ সালে যখন মুম্বাই ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছেন, তখনও জানা ছিল না আবারও একদিন বাইশগজে তিনি বল হাতে ছুটবেন। প্রায় এক দশক পর সেই সৌরভ নরেশ নেত্রভালকার এখন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম আলোচিত নাম। পড়াশোনা শেষে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওরাকল ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচারে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে এসে বিশ্বকাপে খেলতে নামা তার জন্য স্বপ্নের, সেই স্বপ্ন বাস্তব হতেই গড়েছেন ইতিহাস। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেটের জন্ম দিয়ে সৌরভের নৈপুণ্যে পাকিস্তানকে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে যখন আয়োজক দেশটির হয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য ডাক পান সৌরভ, তখন বলেছিলেন, ‘এটি খুবই আবেগঘন ডাক। আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য এসেছিলাম, কখনোই ভাবিনি যে আবারও ক্রিকেট খেলতে পারব। এমনকি আমার ক্রিকেট জুতাও আনা হয়নি। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল পড়াশোনায়। (স্থানীয় ক্রিকেট খেলা দেখে) পরেরবার ভারত গিয়ে নিজের খেলার সামগ্রীগুলো নিয়ে আসি।’ ক্রিকেট নিয়ে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া মুম্বাইয়ের এই বোলারের হাত ধরেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা জয়টি পেল।

ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে পাকিস্তান–যুক্তরাষ্ট্র টস দিতে নামার সময়ও হয়তো কেউ ভাবেননি, ম্যাচ শেষে কী ঘটতে চলেছে। অকল্পনীয় সেই দৃশ্য বাস্তব হয়েছে ক্রিকেটের নবীনতম দেশ মার্কিনীদের নির্ভীক ও ম্যাচিউর মনোভাব নিয়ে করা পারফরম্যান্সে। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান সর্বসাকূল্যে তোলে ১৫৯ রান। সেই রানতাড়া করা যে সম্ভব এমন মানসিকতা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটাররা শুরু থেকেই দেখিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যদিও সমতা দিয়ে নির্ধারিত খেলা শেষ হয়। এরপর চরম রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা ঠাসা মুহূর্তে স্নায়ু ধরে রেখে সুপার ওভারে সফল হয়েছেন নেত্রভালকার।

অবসর ভেঙে ফেরা মোহাম্মদ আমিরের মতো অভিজ্ঞ পেসার যেখানে ওভার শেষ করলেন ৯ বলে, সেই চাপ যেন ছুঁতে পারেনি এই ভারতীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন পেসারকে। তিনটি ওয়াইডের সঙ্গে অতিরিক্ত রান মিলিয়ে আমির দেন ১৮ রান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র একটি চারের বাউন্ডারি খেলতে পেরেছিল। সেই রানতাড়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়াইড দিয়ে শুরু করলেও, স্লো আর কাটারের মিশ্রণে মোট ১৩ রান দেন নেত্রভালকার। সুপার ওভারে ৫ রানের জয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন সুপার এইটে খেলার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

তবে ওই রাউন্ডের ম্যাচ আসার আগেই যে ছুটি শেষ হয়ে যাবে নেত্রভালকারের। কারণ তিনি ওরাকল থেকে অফিস ছুটি নিয়েছেন ১৭ জুন পর্যন্ত, ১৪ জুন পর্যন্ত চলবে গ্রুপপর্বের ম্যাচ। ইতোমধ্যে দুই ম্যাচ জেতা আমেরিকানদের সুপার এইট নিশ্চিতে কেবল একটি জয় দরকার। সামনে ম্যাচ আছে ভারত ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে। অর্থাৎ ছুটির মেয়াদ বাড়াতে হতে পারে ৩২ বছর বয়সী এই পেসারকে। এর আগে ম্যাচে মূল অংশে ৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট, ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৪.৫০। সুপার ওভারেও ১৩ রানে নেন এক উইকেট।

নেত্রভালকার এখন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটের গর্ব। এর বাইরেও পরিচয় আছে তার। তিনি ভারতীয়, ২০১০ সালে লোকেশ রাহুল, মায়াঙ্ক আগারওয়ালদের সঙ্গে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপেও খেলেছেন। নিউজিল্যান্ডে হওয়া সে আসরে পাকিস্তানের কাছে হেরে ভারতের যাত্রা থেমে গিয়েছিল। বাবর আজম, আহমেদ শেহজাদদের সেই দলের কাছে শেষ ওভারে ২ উইকেটে হেরে যায় নেত্রভালকারের দল। সে স্মৃতি স্মরণ করে আইপিএলের দল লখনৌ সুপার জায়ান্টসহ অনেকেই পোস্ট দিয়েছেন, ১৪ বছর পর নেত্রভালকারের প্রতিশোধ! অনেক শুভেচ্ছার ভীড়ে হয়তো নিজের প্রতিষ্ঠান ওরাকলের বার্তাও তার আনন্দ বাড়িয়ে দেবে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের পর পরিবারের সঙ্গে সৌরভ নেত্রভালকার

যেখানে ওরাকল এক টুইট বার্তায় সৌরভকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছে, ‘ঐতিহাসিক এই জয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শুভেচ্ছা। দলের পাশাপাশি আমাদের ইঞ্জিনিয়ার এবং ক্রিকেট তারকা সৌরভের জন্যও গর্বিত।’ গত আট বছর ধরেই এই সংস্থায় কাজ করছেন সৌরভ নেত্রভালকার, বর্তমানে রয়েছেন প্রিন্সিপাল মেম্বার অফ টেকনিক্যাল স্টাফ পদে। শুভেচ্ছা বার্তাটি দেওয়ার ভারত ও অন্য দেশের ক্রিকেটভক্তরাও এখন সৌরভকে পুরস্কৃত করার দাবি জানিয়েছে। কর্মস্থলে তার ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি কিংবা সেরা কর্মী ঘোষণার মতো উদ্যোগের আহবানও জানিয়েছেন নেটিজেনদের কেউ কেউ।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে মুম্বাইতে জন্ম সৌরভ নেত্রভালকারের। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি মাস্টার্স করতে মার্কিন মুলুকে চলে যান। সেখানে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অনুশীলনের সুযোগ পেলেও, ওরাকলে পূর্ণ পেশাজীবী হওয়ার পর সেই সুযোগও পাওয়া যেত না। তবুও নিজের মতো করে সময় বের করতেন নেত্রভালকার। ২০১৭ সালে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ইলেভেনের হয়ে নেত্রবালকার খেলেন যুক্তরাষ্ট্র একাদশের বিপক্ষে। যেখানে দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর ২০১৮ সালে ডাক যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলে খেলার।

ভারতের হয়ে ২০১০ যুব বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন সৌরভ

এর আগে ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পাশাপাশি মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন এই পেসার। ২০১০ সালে লোকেশ রাহুল, মায়াঙ্ক আগারওয়াল ও জয়দেব উনাদকাটদের সঙ্গে যুব বিশ্বকাপ খেলা নেত্রভালকার সেসব অতীত পেছনে ফেলে এসেছেন। এখন তিনি যেমন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন, মার্কিন দলের হয়ে নাম তুলেছেন ক্রিকেট ইতিহাসেও।

এএইচএস