আরও একটি বিশ্বকাপ দুয়ারে এসে হাজির। বলতে গেলে ক্রমাগত বাজতে থাকা দামামায় আনুষ্ঠানিক আঘাতের অপেক্ষা কেবল। আগামী ২ জুন থেকে শুরু হতে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব পেরোনোর লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রেখেছে বাংলাদেশ দল। এদিকে, বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট মানেই দলটির তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে বাড়তি নজর। যা ছিল সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং এশিয়া কাপেও তুমুল আলোচ্য বিষয়ের একটি। এবারও আইসিসির মেগা আসরের আগে নতুন করে সেই আলাপ উসকে দিয়ে দেশ ছেড়েছেন টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।

তার মন্তব্যে ছিল দুটি নাম— সাকিব আল হাসান এবং শান্ত নিজেই। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের অবর্তমানে গত ১২ মাস (জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগপর্যন্ত) টি-টোয়েন্টিতে শান্তই তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করে আসছেন। কিন্তু সাকিব যখন স্বয়ং হাজির, সে সময় তিনি নাকি শান্ত হবেন তিন নম্বরের ভরসা– এমন প্রশ্ন এসে যায়। আলোচনা হতে পারে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তাওহীদ হৃদয়কে নিয়েও। সর্বশেষ বিপিএল আসরে তিন নম্বরে ব্যাট করে সফল এই ডানহাতি ব্যাটারকে ইতোমধ্যে জিম্বাবুয়ে সিরিজের এক ম্যাচে ওয়ানডাউনে খেলিয়েছেন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ফলে পরিস্থিতি বুঝে তাকেও যে তিন নম্বরে খেলানো হতে পারে– এটা যেন তারই ইঙ্গিত!

কেবল বাংলাদেশই নয়, ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর জায়গাটা সাধারণত দলের সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য বরাদ্দ থাকে। ভারতের বিরাট কোহলি, অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ, ইংল্যান্ডের জো রুট, নিউজিল্যান্ডের কেইন উইলিয়ামসন এই পজিশনেই ব্যাট করতে নামেন, বলতে পারেন তাদের সবাই তো আর টি-টোয়েন্টিতে নিয়মিত নয়। ফরম্যাট ভিন্ন হলেও, তিন নম্বরে সেরা ও নির্ভরযোগ্য কাউকে রাখা যেন চিরাচরিত নিয়ম। যারা হয়তো উড়ন্ত সূচনাকে কাজে লাগিয়ে ম্যাচ টেনে নিয়ে যাবেন, নতুবা শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে মিডল অর্ডারদের সঙ্গে একটি যোগসূত্র স্থাপন করবেন। একটা সময় স্যার ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, কুমার সাঙ্গাকারা, রিকি পন্টিং, জ্যাক ক্যালিস, রাহুল দ্রাবিড়, মারভান আতাপাত্তুর মতো কিংবদন্তিরাও ব্যাট করেছেন তিন নম্বরে।

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্কোয়াড

এবার বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফেরা যাক। বিশ্বকাপে টাইগারদের তিন নম্বর ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন নিয়ে শান্তর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি কন্ডিশন এবং প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে, তবে এমনটা (তিন নম্বরে সাকিবের ব্যাটিং) হতেই পারে।’ একইভাবে পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন কোচ হাথুরুসিংহেও। তবে নির্দিষ্ট কোনো পজিশন পরিবর্তনের কথা স্পষ্ট না করে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন হতেই পারে। ক্রিকেটে এটা স্বাভাবিক। দেখতে হবে আপনি কোথায় ব্যাট করছেন এবং এক্ষেত্রে আপনি কতটা সেরা।’

সাকিব নাকি শান্ত, পরিসংখ্যান কী বলে?

দীর্ঘ ১০ মাস পর জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ফেরেন সাকিব। তার এবারের প্রত্যাবর্তনটা হয়েছে অধিনায়কত্বের ভার নামিয়ে, ফলে শান্ত এখন তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের আর্মব্যান্ড শক্ত করে নিজের বাহুতে বেঁধে নিয়েছেন। বাংলাদেশের তিন নম্বর ব্যাটিং অর্ডার সাকিবের পছন্দের, তামিম ইকবাল অধিনায়ক থাকাকালে তিনি সেই জায়গা হারানোর অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে নিজেই অধিনায়ক হওয়ার পর পুনরায় সেই অবস্থানে ব্যাট করা শুরু করেন এই অলরাউন্ডার। তবে শান্ত’র অধীনে সবশেষ দুই ম্যাচে সাকিব পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন। চারে নামেন হৃদয়।

বিশ্বকাপে টাইগারদের তিন নম্বর ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন নিয়ে শান্তর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি কন্ডিশন এবং প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে, তবে এমনটা (তিন নম্বরে সাকিবের ব্যাটিং) হতেই পারে।’
একইভাবে পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন কোচ হাথুরুসিংহেও। তবে নির্দিষ্ট কোনো পজিশন পরিবর্তনের কথা স্পষ্ট না করে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন হতেই পারে। ক্রিকেটে এটা স্বাভাবিক। দেখতে হবে আপনি কোথায় ব্যাট করছেন এবং এক্ষেত্রে আপনি কতটা সেরা।’

এর আগে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের বড় সংখ্যক ম্যাচ সাকিব খেলেছেন তিনে। ৪২ ইনিংসে তিনে ব্যাট করে ৩৭ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার ২৯.৩২ গড় আর ১২৩.১৫ স্ট্রাইকরেটে ১০৮৫ রান করেছেন। আন্তর্জাতিক ফরম্যাটটিতে ১২ ফিফটির ৭টিও করেছেন এই পজিশনে। যদিও সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক ম্যাচ ছাড়া বাকিগুলোতে ৪ নম্বরে ব্যাট করেছেন সাকিব। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৫ ইনিংসে চারে নেমে তিনি ১২৭.১৬ স্ট্রাইকরেটে ৮৮০ রান করেন। এ ছাড়া পাঁঁচে নেমে ১৬.২৬ গড় ও ১১০.৭৫ স্ট্রাইকরেটে ৩০৯ রান এবং ছয়ে ব্যাট করে ৩০.৩৩ গড় ও ১৩০ স্ট্রাইকরেটে ৯১ রান করেন সাবেক এই অধিনায়ক।

বিশ্বকাপে ফর্মের সঙ্গে শান্ত’র শোভনীয় স্ট্রাইকরেটও খুব বেশি করে চায় বাংলাদেশ

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা খুঁজে ফেরা অধিনায়ক শান্ত ৩৬ ইনিংসের অর্ধাংশ ব্যাট করেছেন তিনে। যদিও এর বেশিরভাগই সাকিবের অনুপস্থিতিতে। সর্বশেষ বিশ্বকাপে ওপেনিং করা এই টাইগার ব্যাটার টি-টোয়েন্টির ১৮ ইনিংসে তিনে ব্যাট করে ২৭.৭৩ গড় এবং ১১৩.৬৬ স্ট্রাইকরেটে ৪১৬ রান করেছেন। এ ছাড়া ওপেনিংয়ে ৯ ইনিংসে ২৭.৪৪ গড় এবং ১১১.২৬ স্ট্রাইকরেটে ২৪৭ রান করেন শান্ত। বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া ২০ দলের অধিনায়কদের মাঝে স্ট্রাইকরেটে তার অবস্থান ১৯ নম্বরে। ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের কোনো পজিশনের ব্যাটিংই যে টি-টোয়েন্টি সুলভ নয় সেটি পুরোনো কথা, যা আরও দৃষ্টিকটু ছিল সবশেষ জিম্বাবুয়ে সিরিজে। চার ইনিংসে ৭৮ বল খেলে তার রান মোটে ৮১ (স্ট্রাইকরেট ১০৩.৮৪)। সবশেষ বিপিএলেও শান্ত’র ব্যাটে ছিল চৈত্রের খরা! অবশ্য বিশ্বকাপের আগে তার নিজেকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ।

পরিসংখ্যান যার পক্ষেই কথা বলুক, সাকিব–শান্ত’র এই স্নায়ুযুদ্ধে আরও একটি বিষয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এসে যায়। সেটি হচ্ছে সাকিবের চোখের দৃষ্টিজনিত সমস্যা। ভারত বিশ্বকাপে এমন সমস্যা নিয়ে বেশ ভুগেছেন টাইগার অলরাউন্ডার। যার জন্য দীর্ঘ সময় তিনি জাতীয় দলের বাইরেও ছিলেন। মাঝে বিপিএল এবং শ্রীলঙ্কা সিরিজের শেষ টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা এই তারকার চোখের সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি। ফলে তাকে ব্যাটিংয়ের সময় মাথার পজিশন বদল ও এক চোখে অতিরিক্ত চাপ নিয়ে বল মোকাবিলা করতে দেখা যায়। বিষয়টিও তার ব্যাটিং পজিশন বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে!

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হতেই নিজের পুরোনো আগ্রাসী ব্যাটিং ফিরে পেতে অনুশীলনে নেমে পড়েন সাকিব

বিকল্প হতে পারেন হৃদয়, রয়েছে বাঁহাতি–ডানহাতি সমীকরণ

লাল-সবুজের জার্সিতে এখন পর্যন্ত কেবল একটি টি-টোয়েন্টি ইনিংসে তিনে ব্যাট করেছেন হৃদয়, তাতেও করেছেন মোটে ১২ রান। ফলে তিন নম্বর ব্যাটিংয়ের আলোচনায় কেন এই তরুণ ব্যাটার, এমন প্রশ্ন জাগতে পারে। সেই উত্তর মিলতে পারে ২০২৪ বিপিএলে কুমিল্লার হয়ে হৃদয়ের পারফরম্যান্স এবং টাইগার টপ–অর্ডারে বাঁ–হাতি ব্যাটারের সংখ্যায় চোখ রাখলে। বাংলাদেশের ওপেনিংয়ে দুই অভিজ্ঞ সৌম্য সরকার ও লিটন দাসের সঙ্গে ভালোভাবেই বিবেচনায় আছেন তানজিদ হাসান তামিম। ফর্মহীন লিটন কোনো কারণে একাদশে না থাকলে, তানজিদ–তামিম ওপেন করবেন। তারপর শান্ত ও সাকিব মিলিয়ে টানা চারজন টপ অর্ডারই বাঁ–হাতি।

মজার বিষয় হচ্ছে, টাইগার টিম ম্যানেজমেন্টের পছন্দের বাঁহাতি–ডানহাতি কম্বিনেশন বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি বড় অন্তরায়। ফলে অতীতের অলিখিত রীতি ধরে রাখতে চাইলে মাঝে (তিনে) ডানহাতি বিবেচনায় হৃদয়কে খেলানো হতে পারে! তবে জিম্বাবুয়ে সিরিজে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই চারে ব্যাট করা ২৩ বছর বয়সী এই ব্যাটারকে একই পজিশনে বিশ্বকাপেও দেখার সম্ভাবনা বেশি।

জিম্বাবুয়ে সিরিজে ১৪৭ স্ট্রাইকরেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান হৃদয়ের, শীর্ষে ছিলেন তানজিদ তামিম

এখন পর্যন্ত ১৭টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা হৃদয় ১২ ইনিংসেই চারে ব্যাট করেছেন। ওই পজিশনে ২৯.৭৭ গড় এবং ১৩৩.৩৩ স্ট্রাইকরেটে ২৬৮ রান করেন তিনি। এ ছাড়া পাঁচে নেমে ৪ ইনিংসে ৩০.৩৩ গড় এবং ১৩৩.৮২ গড়ে ৯১ রান এসেছে হৃদয়ের ব্যাটে। অন্যদিকে, তিনি এবারের বিপিএলে ১৪ ম্যাচে ৩৮.৫০ গড় এবং ১৪৯.৫১ স্ট্রাইকরেটে ৪৬২ রান করেছেন। যা ছিল আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। এর মধ্যে ১০ ম্যাচেই তিনে ব্যাট করেছেন হৃদয়।

সবমিলিয়ে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে অদলবদলের বিষয়টা নির্ভর করছে ম্যাচের পরিস্থিতি ও টিম কম্বিনেশনের ওপর। নির্দিষ্ট ম্যাচে প্রতিপক্ষের সামর্থ্য দেখে যে বদল আনা হতে পারে সেই ইঙ্গিত টাইগার কোচের মন্তব্যেই মিলেছে। ব্যাটিং পজিশনে বদল আনা হোক কিংবা অপরিবর্তিত; যে অবস্থাতেই নামুক না কেন, শান্তরা যেন নিজেদের পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে শেষ হাসি হাসতে পারেন সেটাই সবার চাওয়া। ২ জুন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নবম আসর বসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ৮ জুন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশ নিজেদের অভিযান শুরু করবে।

এএইচএস