মাস ছয়েক আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন অ্যালান ডোনাল্ড। ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর খানিক অভিমানী হয়েই বিদায় নিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে। তবে বলে গিয়েছিলেন, টাইগার ক্রিকেটের খোঁজ তিনি রাখবেন। সেই খোঁজ রেখেছেন। শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ে সিরিজে চোখ রেখেছেন। দেখেছেন সাবেক শিষ্যদের খেলা। 

গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিতব্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তিন সদস্যের নির্বাচক প্যানেল। ঘোষিত দলে খুব বড় চমক রাখেননি নির্বাচকরা। বলার মতো দিক হিসেবে বলা যায় পেসার তাসকিন আহমেদের সহ-অধিনায়ক পদে আসা। আর সাইফউদ্দিনের বাদ পড়া। 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণার পরেই ঢাকা পোস্টের ক্রীড়া প্রতিবেদক সাকিব শাওনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক এই প্রোটিয়া কোচ। জানালেন সাবেক শিষ্যদের নিয়ে ভাবনার কথা। সাকিব আল হাসান, লিটন দাস, নাজমুল শান্তদের নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন 'সাদা বিদ্যুৎ' খ্যাত ডোনাল্ড। ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ডোনাল্ডের সেই বিশেষ সাক্ষাৎকার। 

ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক বেশ দারুণ। বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করা হয়েছে আজ। পুরোনো শিষ্যদের প্রায় সবাই আছে। কেমন লাগলো দল নির্বাচন? 

ডোনাল্ড: দল আমি যেমনটা আশা করেছিলাম, এটা প্রায় তেমনই হয়েছে। অনেকটা সেই দলটাই যাদেরকে আমি জিম্বাবুয়ে বা শ্রীলঙ্কা সিরিজে দেখেছি। কিছু নতুন মুখকে দেখলাম চেষ্টা করে দেখা হয়েছে। সত্যি বলতে আমি এই দলটাকেই আশা করেছিলাম বিশ্বকাপে জায়গা করে নেবে। খুব বেশি আশ্চর্যজনক কিছু ছিল না। ভালো একটা বোলিং অ্যাটাক। ভারসামপূর্ণ আমি বলব। দেখে ভালো লাগছে যে তাসকিন নিজের সেরা ছন্দে ফিরে এসেছে। তাকে দেখেই ভালো লাগছে। ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছে। কিছু ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিল। দারুণ পারফরম্যান্স সত্যি বলতে। হাসান মাহমুদকে খুব একটা দেখলাম না (বিগত সময়ে)। তাই আমি বলব, দল নির্বাচনের দিক থেকে আমি অনেকটা এটাই আশা করেছিলাম। 

ঢাকা পোস্ট: লিটন দাসের অফফর্ম চলছে লম্বা সময় ধরে। তবুও তাকে দলে রাখা হয়েছে। ব্যাকআপ উইকেটরক্ষক জাকের অবশ্য বেশ ছন্দে আছেন। লিটনকে নিয়ে সাবেক কোচ হিসেবে কী বলবেন? 

ডোনাল্ড: লিটন দাস রানের জন্য সংগ্রাম করছে সেটা আমি দেখেছি। তার ওপর অনেকটা চাপ। বিশ্বকাপের বেলায় যা হয়, আমি সবসময় এমন বৈশ্বিক আসরে বিশ্বাস রাখি। অনেকটা দিন অপেক্ষার পর আপনি এমন বিশ্বকাপে জায়গা করে নেন, আর আশা করেন পুরো দলটা ছন্দে থাকবে। বিশেষ করে অভিজ্ঞরা খুব ভালো ক্রিকেট উপহার দেবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লিটনের বেলায়, সে রানের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আর আমি এটা একজন খেলোয়াড় হিসেবে বলছি, কোচ হিসেবে না ‘আমি সবসময় বিশ্বাস করি, দলের মধ্যে ফর্মে থাকা সেরা খেলোয়াড়কে অবশ্যই খেলার সুযোগ দিতে হবে’। 

ঢাকা পোস্ট: তাহলে কী জাকেরকে উইকেটরক্ষক হিসেবে বিবেচনায় রাখা যায়? যেহেতু বলছিলেন সেরা খেলোয়াড়কেই সুযোগ করে দেওয়া উচিত? 

ডোনাল্ড: আমার মনে হয়, বাড়তি উইকেটরক্ষক বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত না, তবে লিটনের জন্য অফফর্মে থেকে এক মাসের মধ্যে বিশ্বকাপে যাওয়া সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এটা দেখার বিষয় চন্ডিকা (হাথুরুসিংহে) দল নিয়ে কী পরিকল্পনা করে। সে কি আগের পরিকল্পনাতেই থাকবে? নাকি জাকেরকে বিবেচনায় আনবে। যদি জাকেরকে নিয়ে এগোতে থাকে, তবে বিষয়টা বেশ আগ্রহ জাগানোর মতো হবে। আপনাকে এই ক্ষেত্রে সাহসী হতে হবে। আর ফর্মে থাকা সেরা খেলোয়াড়কেই দলে নিতে হবে। সে টপ-অর্ডারে দারুণ, তবে কোচ এবং নির্বাচকরা সেটা বিবেচনায় রাখবে কি না দেখতে হবে। 

ঢাকা পোস্ট: আপনি যাওয়ার পরেই অধিনায়ক করা হয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তকে। এই মুহূর্তে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হচ্ছে রানের জন্য। অধিনায়ক হিসেবে এটা কি চাপ হয়ে গিয়েছে তার জন্য? 

ডোনাল্ড: যখন আচমকা অধিনায়কের দায়িত্ব কাঁধে চলে আসে, তখন একজন খেলোয়াড় ভেতর থেকে কেমন সংগ্রাম করতে থাকে, এটা সবসময়ই একটা চমৎকার বিষয়। তখন সেই খেলোয়াড় কীভাবে মাঠে যায় আর পারফর্ম করে… আমি এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে এউইন মরগ্যানের কথা বলব। যেভাবে সে অধিনায়কের চাপ সামাল দিয়ে ক্রিজে এসে মূল্যবান সব রান করে গিয়েছিল। আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন সে অধিনায়ক হয়েছে। তার আগের অফফর্মের কথা আনছি না এখানে। আর আপনি যাচ্ছেন আমেরিকায় খেলতে, সেখানে পিচ কেমন হবে তা আমি জানি না। শান্তর জন্য এটা কঠিন হবে।

ঢাকা পোস্ট: শান্তকে তবে কি সহসাই আগের ফর্মে আবার দেখা যাবে না? 

ডোনাল্ড: আমি তার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, কারণ সে একজন অসাধারণ খেলোয়াড়। শুধুমাত্র সেইই বলতে পারবে, তার ভেতরে কী চলছে। আপনাকে দুটো জিনিসে এসময় লক্ষ্য রাখতে হয়। মাঠে অধিনায়কের অসামান্য চাপ আর তখন ব্যাট হাতেও পারফর্ম করতে হয়। তাই এটা অনেক বড় দায়িত্ব। সবার দ্বারা এটা সম্ভব হয় না যে অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে নেবে আর সবকিছু এমনিই হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, এটা তার পারফরম্যান্সের ওপরেও প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে একটা ভাল ইনিংস দরকার শুধু। একটা ভাল ইনিংস, কিছুটা ভাগ্যের সাহায্য। শান্ত দারুণ একজন ক্রিকেটার, তাকে সেটা বিশ্বাস করতে হবে। 

সাকিব সবসময় যা করে, এই বিশ্বকাপেও তাইই করে যাবে– এটা নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই। ব্যাট হাতে আগ্রাসী, বল হাতে বুদ্ধিদীপ্ত। সে দলকে সাহায্য করবে, এটা নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই। 

ঢাকা পোস্ট: একটা বিশ্বকাপ পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আবার দলে এসেছেন। বিপিএলে আর শেষ দুই সিরিজে দারুণ ব্যাট করেছেন। বিশ্বকাপেও সবার ব্যর্থতার মাঝে ভালো করেছিলেন। তার কাছে কী প্রত্যাশা থাকবে? 

ডোনাল্ড: মাহমুদউল্লাহকে আমি দেখেছি ভারতে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে, সে ঠাণ্ডা মাথায় প্রভাবিত করে সবাইকে। মানুষ হিসেবে অসাধারণ ভারসাম্যপূর্ণ সে। রিয়াদ নিজের সেরাটা দেখিয়েছে বিশ্বকাপে আর কত বড় মাপের খেলোয়াড় সেটাও প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ দলের জন্য এই সিরিজে বা তার আগের সিরিজে সে রান করে গিয়েছে। অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে তার রান, দ্রুত রান তুলেছে, বলে ভালোভাবে সংযোগ ঘটাচ্ছে। তাকে আপনি নতুন করে কিছু শেখাতে পারবেন না। রিয়াদ দারুণ উপভোগ্য একজন খেলোয়াড়। খুব ভাল একটা বলকেও সে সীমানা ছাড়া করতে পারে। আমার মনে হয় সে ভালো করবে। আমি তাকে মানুষ হিসেবে উপভোগ করেছি। খেলোয়াড় দারুণ, মানুষ হিসেবে ভালো, তরুণদের খুব সহায়তা করে। 

ঢাকা পোস্ট: সাকিবকে আপনি দেখেছেন অধিনায়ক হিসেবে। সম্ভবত নিজের শেষ বিশ্বকাপে যাচ্ছেন এই অলরাউন্ডার। শেষ বিশ্বকাপে সাকিবের ভালো করার সম্ভাবনা কেমন দেখছেন? 

ডোনাল্ড: আমি খবরে পড়েছিলাম, এটাই সাকিবের শেষ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরেই সে অবসর গ্রহণ করবে শুনেছি। সে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দারুণ একটা সম্পদ। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি, সাকিব সব ফরম্যাটের জন্যই দুর্দান্ত একজন ক্রিকেটার। সাকিব সবসময় যা করে, এই বিশ্বকাপেও তাইই করে যাবে– এটা নিয়ে আমার মনে কোন সংশয় নেই। ব্যাট হাতে আগ্রাসী, বল হাতে বুদ্ধিদীপ্ত। সে দলকে সাহায্য করবে, এটা নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই। 

আমার মনে হয়, সাকিব নিশ্চিন্ত থেকে নিজের খেলা উপভোগ করতে পারবে। সাধারণত এটাই হয় মাঠে। সে নিজের স্বাধীনচেতা মন নিয়ে মাঠে যায়। সে বিশ্বাস করে দিনটা তার হবে। (প্রতিপক্ষকে) চাপে ফেলে রান করে যাবে আর উইকেট নেবে। 

ঢাকা পোস্ট: সাকিবকে বাংলাদেশ মিস করবে ভবিষ্যতে? 

ডোনাল্ড: আমার মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা সাকিবকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মিস করবে। সে অনেকটা দিন ধরেই বাংলাদেশের জন্য দারুণ এক ক্রিকেটার। আমি আশা করি সে খুব ভালো একটা বিশ্বকাপ পার করবে। আর আমি যেমনটা বিশ্বাস করি, ঠিক তেমন করেই সাকিব নিজের ক্যারিয়ার শেষ করবে। তার দিকে লক্ষ্য রাখবেন। 

ঢাকা পোস্ট: পেস বোলিং কোচ হিসেবে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আপনার সময়ে বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ উন্নতি করেছিল। বিশ্বকাপে কেমন প্রত্যাশা এসব বোলারদের কাছ থেকে? 

ডোনাল্ড: বাংলাদেশের পেস বোলিং বিভাগ গত কয়েক বছর ধরেই বেশ ধারাবাহিক। তাদের ভিতটা অনেক ভালো। তাসকিন এই দলটাকে ভালোভাবেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর আমি মনে করি, বিশ্বকাপেও ভালোই করবে ওরা। নতুন বোলিং কোচের অধীনে তাদের উন্নতি দেখে ভালো লাগছে। আমি তাদের শুভকামনা জানাই। আমার কোনো ধারণা নেই যুক্তরাষ্ট্রে উইকেট কেমন হবে। সত্যি বলতে যুক্তরাষ্ট্রে গরম থাকবে। আমি ওটার জন্য মুখিয়ে আছি। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজে পিচ খানিক ধীর হবে এটা সবাই জানি। টুর্নামেন্ট যত এগুবে পিচ ততই ধীর হবে। তাই স্পিনাররা ভালো করবে। আমার কোনো সন্দেহ নেই, তারা বিশ্বকাপে দারুণ সব বোলিং উপহার দেবে। আর গত কয়েক বছরে যেমন ধারাবাহিক ছিল, সেটা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি।   

এসএইচ/জেএ/এফআই