দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা আবাহনী। ফুটবলের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেলেও ক্রিকেট লিগ শিরোপায় দেশের অন্য সব ক্লাবের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে তারা। আবাহনী ক্রিকেট দলের এই সফলতার নেপথ্যে রয়েছেন এক সাবেক ফুটবলারও। আবাহনীর সাবেক গোলরক্ষক শেখ মাসুদ ইকবাল মামুন প্রায় দুই দশক আবাহনীর ক্রিকেট দলের ম্যানেজার। 

জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন আবাহনীর ক্রিকেট কোচ অনেকদিন থেকেই। তার হাত ধরেই আবাহনীর অনেক শিরোপা এসেছে। কোচ সুজন সাফল্যের নেপথ্যে ম্যানেজার মামুনকে দিলেন বিশেষ অবদান, ‘আবাহনী ক্রিকেট দল শুধু এখন আর দল নয় পরিবার। সেই পরিবারের হার্ট মামুন ভাই। হার্ট ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না। তেমনি মামুন ভাই ছাড়া আবাহনী ক্রিকেট দলও অকল্পনীয়।’

আবাহনীর খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের সঙ্গে ম্যানেজার শেখ মাসুদ ইকবাল মামুন। 

মাঠে খেলেন ক্রিকেটাররা, কৌশল সাজান কোচ। সাদা-চোখে এটুকু ধরা পড়লেও একটি দলের সাফল্যের শেকড় অনেক গভীরে। সেখানেই মামুনের মূল অবদান দিলেন সুজন, ‘যে কোনো খেলায় সাফল্যের মূল কৃতিত্ব অবশ্যই খেলোয়াড়দের। সেই হিসেবে আমি ও মামুন ভাই অবশ্যই উহ্য। একটি দল সফল হতে অনেক কিছু প্রয়োজন মাঠে ও মাঠের বাইরে। নিবেদন, ভালোবাসা, শৃঙ্খলাসহ নানা বিষয় মামুন ভাই অনন্য ও শিক্ষণীয়। আমাদের ড্রেসিংরুমে হার্ট মামুন ভাই। ক্লাবের প্রতি তার ভালোবাসা ও আন্তরিকতা অনন্য পর্যায়ের। যেটা কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড়দের মধ্যেও বহন হয়। যা আসলে আর্থিক অঙ্কে বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়।’

আধুনিক ও পেশাদার যুগে ক্লাবের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিনকে দিন কমছে। এখানেও ব্যতিক্রম মামুন। সুজন একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন,‘আমরা অনেক সময় বলি মামুন ভাই ছোট-খাটো বিষয়েও কৃপণতা করেন কেন? তিনি বলেন, ‘আরে তোরা বুঝবি না, অর্থ বাঁচলে তো সেটা ক্লাবেরই উপকার।’ এটা তিনি করেন ক্লাবকে ভালোবেসে অন্তর থেকেই। মামুন ভাই একেবারে নিঃস্বার্থভাবে ক্লাবকে ভালোবাসেন।’

ফুটবলের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেলেও ক্রিকেট লিগ শিরোপায় দেশের অন্য সব ক্লাবের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আবাহনী।

ফুটবল গোলরক্ষক হিসেবে আবাহনীর সঙ্গে ছিলেন ১৯৮৩-৯৫। ১৯৯৯ থেকে অদ্যবধি ক্রিকেট দলের সঙ্গে। সব মিলিয়ে আবাহনী ক্লাবের সঙ্গে মামুনের সম্পৃক্ততা প্রায় চার দশক। আশির দশকে শুরুর দিকে আবাহনীতে আসার গল্পটা বললেন মামুন, ‘সত্তর-আশির দশকে ফুটবলের তুমুল জনপ্রিয়তা। তখন আমি ফুটবল-ক্রিকেট উভয় খেলি বরিশালে। ঢাকায় এসেছিলাম ক্রিকেট খেলতে মূলত (কিংবদন্তি গোলরক্ষক শহিদুর রহমান চৌধুরী সান্টুও রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ক্রিকেট খেলতে)। সাধারণ বীমায় ক্রিকেটও খেলেছি। আবাহনীর প্রয়াত কোচ আলী ইমাম ভাই আমাকে ফুটবল দলে অনুশীলন করতে বলেন। এরপর থেকে ফুটবলেই মনোযোগ দিই। ক্রিকেট আর সেভাবে খেলিনি।’

১৯৮৬ সালের ফেডারেশন কাপ মামুনকে ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ পরিচিতি দেয়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের বিপক্ষে টাইব্রেকারে বদলি গোলরক্ষক হয়ে মাঠে নেমে তিনটি শট ঠেকিয়ে আবাহনীকে জেতান মামুন। আশির দশকে আবাহনীর গোলরক্ষক ছিলেন মোতালেব, মহসিন। বিদেশি গোলরক্ষক চন্দ্রশিরিও ছিলেন। তাই মামুনকে দ্বিতীয় গোলরক্ষক হিসেবেই থাকতে হয়েছে ক্যারিয়ার জুড়ে। খেলার সুযোগ না পেয়ে অনেকে দল ছাড়লেও মামুন ক্লাবকে ভালোবেসে থেকেছেন, ‘আবাহনী ক্লাবকে নিজের মনে হয়েছে। তাই আর ছাড়িনি। আবাহনীতে প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ারে ১৫-২০ ম্যাচ খেলেছি আর বদলি গোলরক্ষক হিসেবে আরো বেশি। বয়স ভিত্তিক জাতীয় দলে খেললেও সিনিয়র দলে খেলার সুযোগ পাইনি।’

১৯৯৫ সালে আবাহনী থেকে ফুটবলার হিসেবে অবসর নেওয়ার পর আবার সেই পুরনো প্রেমে ক্রিকেটে ফিরে যান। আবাহনীর ক্রিকেট দলের খেলা দেখতে ছুটে যেতেন। সব সময় থাকতেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে। ১৯৯৯-২০০ মৌসুম থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ‘কামাল ভাই (আহম মোস্তফা কামাল- আবাহনীর পরিচালক, বিসিরি সাবেক সভাপতি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী) আমার ক্রিকেটের আগ্রহ দেখে দলের সঙ্গে কাজ শুরু করতে বলেন। প্রথম বছর আমি লিয়াজো অফিসার ছিলাম। এরপর ২০০১-০৫ লজিস্টিক ম্যানেজার। ২০০৬ থেকে এখন পর্যন্ত ম্যানেজার হিসেবেই আছি।’ আবাহনীর ফুটবলার ও ক্রিকেট ম্যানজোর উভয় ভূমিকায় শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে মামুনের। তাই তিনি খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন,‘আবাহনীতে ক্রীড়াবিদ-সংগঠকদের অনেক রেকর্ড-কীর্তিই রয়েছে। তবে দুই খেলায় দুই ভূমিকায় শিরোপা জয়ের অংশীদার বোধ হয় কেউ নেই। এতে আমি অত্যন্ত গর্বিত।’

আশি-নব্বইয়ের দশকে আবাহনী ক্রিকেট দলের ম্যানেজার ছিলেন আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, জিএস হাসান তামিম, জালাল ইউনুস, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুরা। ক্রিকেট বোর্ড ও অন্যান্য দায়িত্বে তাদের ব্যস্ততা বাড়ায় তারা অনেক দিন দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। এক সময় ম্যানেজারদের অর্থ যোগাড় থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হতো। অনেক দিন থেকেই আবাহনী ক্রিকেট দল বেক্সিমকো গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই ম্যানেজারের দায়িত্বটা এখন মূলত শুধু ব্যবস্থাপনার মধ্যেই। এরপরও নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্রে মামুনের অংশগ্রহণ থাকে বলে মন্তব্য, ‘দল গঠনের সময় আমরা সবাই মিলেই করি। আমি অনেক সময় বলি ঐ খেলোয়াড়কে নেওয়া যায় আবার সুজনও আমাকে জানায়, ' মামুন ভাই এবার আমরা ওকে নিচ্ছি। আমরা সম্মিলিত ভাবেই দল গঠন ও পরিচালনা করি'। 

জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটারদের আচার-আচরণ ও শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠে অনেক সময়। একজন ফুটবলার হয়েও ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হিসেবে যোগ্য সম্মান পান বলে মন্তব্য মামুনের, ‘গত বিশ বছরে জাতীয় দলে খেলেছে আবাহনীতে খেলে নাই এমন ক্রিকেটার নেই বললেই চলে। সকল ক্রিকেটারের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। সেটা সাকিব-তামিম থেকে শুরু করে উদীয়মান পর্যন্ত। মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রিকেটোরদের অনেক সমস্যায় আমি উপস্থিত হলে সম্মানার্থে তারা শান্ত হয়েছে আবার আমার কথাকেও গুরুত্ব দিয়েছে অনেক ঘটনায়।’ আবাহনীর কোচ সুজনও মামুনের যোগ্য সম্মানের ব্যাপারে সচেষ্ট, ‘মামুন ভাই একজন সিনিয়র স্পোর্টসম্যান। বড় ভাই হিসেবে আমি তাকে সব সময়ই সম্মান করি এবং ম্যানেজার হিসেবে তিনি দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমার দলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের কাছেও তিনি অত্যন্ত সম্মানের ও শ্রদ্ধেয়।’

আবাহনীর শুধু পুরুষ ক্রিকেট দল নয় নারী দলেও রয়েছে মামুনের অসামান্য অবদান। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন মামুন, ‘২০০৬-৭ সালের দিকে আমি আবাহনী মাঠে নারী ক্রিকেটের অনুশীলন শুরু করি। সামাজিক ও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও চালিয়ে গেছি। এখন আবাহনীর নারী ক্রিকেট দলও প্রতিষ্ঠিত। ২০০১ সালে লেবেল ১ কোচিং কোর্স করা মামুন নারী দলে কোচিংও করিয়েছেন। 

ঢাকা প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগে আবাহনীর প্রাধান্য একচ্ছত্র। ফুটবলেও এক সময় ছিল। ২০১৮ সালে বসুন্ধরা কিংসের আগমনের পর থেকে আবাহনী লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারছে না। সাবেক ফুটবলার মামুন এতে ব্যথিত, ‘ক্রিকেট দলে থাকলেও ফুটবলার মামুনই আমার আসল পরিচয় ক্রীড়াঙ্গনে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি সব খেলায় আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য খেলে। ফুটবল লিগে আবাহনী অর্ধযুগ চ্যাম্পিয়ন ছাড়া এটা খুব খারাপ লাগে। আমাদের আরও বেশি পরিকল্পনা ও সংগঠিত হতে হবে শিরোপা পুনরুদ্ধারের জন্য।’

আশির দশকে ফুটবল ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এখন সেই ফুটবলের অবস্থান ক্রিকেটের পেছনে। সাবেক ফুটবলার হিসেবে মামুনকে পোড়ায় বিষয়টি, ‘আহ ফুটবলের সেই দিনগুলো এখন রূপকথা মনে হয় অনেকের কাছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে সবাই ঘরোয়া ফুটবল দেখেছে। ঐ সময় আন্তর্জাতিক খেলা কম ছিল। এখন সবাই আন্তর্জাতিক ফুটবল ও ক্রিকেট দেখতে অভ্যস্ত। ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলছে; ফুটবলও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা অবস্থানে আসতে পারলে অবশ্যই মানুষ ফুটবলও আগের মতো জোয়ার আসবে।’

এজেড/এফআই