২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডের সিরিজেরও শেষ ম্যাচ। ওই সিরিজের অধিনায়ক লিটন কুমার দাস বিশ্রামে যাওয়ায় প্রথমবার নেতৃত্ব পান নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপরের গল্পটা বেশ নাটকীয়। পঞ্চপান্ডব পরবর্তী অধিনায়কের বিবেচনায় থাকা লিটনের জায়গাটা পেয়ে যান শান্ত। 

অধিনায়ক শান্তর নেতৃত্বে তিন ফরম্যাটেই কিউইদের বিপক্ষে ইতিহাসগড়া জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট জয়ের কীর্তির পর নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতেও আরাধ্য জয়খরা ঘুচিয়েছে টিম টাইগার্স। এমন অভাবনীয় সাফল্যের পর শান্তর জাতীয় দলের নেতৃত্বের ব্যাটন পাওয়া অনেকটা অনুমিতই ছিল। তবে তাকে নিয়ে দলের নেতৃত্বের ভাবনাচিন্তাটা শুরু হয় বিশ্বকাপ থেকেই। ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন টপ অর্ডার এই ব্যাটার। সাকিবের চোটে দুটি ম্যাচে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি।

লিটনের সুযোগ কাজে লাগালেন শান্ত

লিটন বিশ্রামে যাওয়ায় প্রথমবার দলের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপর অধিনায়কত্ব নিয়ে নিজের চাপা স্বপ্নের কথাও অকপটে বলেছিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। এর আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা থাকা এই ব্যাটার বলেছিলেন, 'দেশকে নেতৃত্ব দেওয়াটা তার জন্য সম্মানের। ভবিষ্যতে যদি দেশের হয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার সেই সুযোগ আসে অবশ্যই সেটা করার চেষ্টা করবো। এটা আসলে প্রত্যেকটা ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন।'

শান্তর আগে অধিনায়কত্বের দৌড়ে বিসিবির রাডারে ছিলেন লিটন কুমার দাস। তামিম ইকবালের ইনজুরিতে ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। এরপর আফগানদের বিপক্ষে টেস্টেও আর্মব্যান্ড ছিল তার হাতে। সব ঠিক থাকলে বিশ্বকাপে সাকিবের ডেপুটিও তিনিও হতেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন্সির চাপ ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলতে পারে, এই ভেবে সহ-অধিনায়ক হননি লিটন, সুযোগটা পেয়ে যান শান্ত। শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগটা কাজেও লাগালেন। 

সাকিবকে সরিয়ে যে কারণে শান্ত বিবেচিত হলেন

তামিম ইকবাল ওয়ানডের নেতৃত্ব ছাড়ার পর গেল বছর এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে সাকিব আল হাসানকে নতুন নেতা ঘোষণা করা হয়। আগে থেকে দুই ফরম্যাটে অধিনায়ক থাকা সাকিবের ওয়ানডে নেতৃত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে ফের এক অধিনায়কের যুগে ফেরে বাংলাদেশ। যদিও বিশ্বকাপের পর আর একদিনও অধিনায়ক থাকবেন না এমন কথা আগেই জানিয়েছিলেন সাকিব। তবে ধারণা ছিল সেটি শুধু ওয়ানডেতে। শেষ পর্যন্ত তিন ফরম্যাটেরই নেতৃতৃব ছাড়লেন অথবা ছাড়তে হলো টাইগার অলরাউন্ডারকে। 

চোখের সমস্যা নিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকেই বেশ ভুগছেন সাকিব আল হাসান। একাধিক দেশে ডাক্তার দেখিয়েও কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। চোখের সমস্যার প্রভাব পড়ছিল তার খেলাতেও। তার মাঠে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় দলনেতা হিসেবে শান্তকে বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছে বোর্ড। এ ব্যাপারে সাকিবের সঙ্গেও কথা বলেছে বিসিবি। বোর্ড সভা শেষে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন গণমাধ্যমকে বলেন, 'ওর সঙ্গে এখন অবধি কালকে পর্যন্ত যেটা কথা হয়েছে; ওর চোখের সমস্যা এখনও যায়নি। কাজেই আমাদের সামনে শ্রীলঙ্কা সিরিজ আছে, তারপর আরেকটা সিরিজ আছে; বিশ্বকাপ আছে।আসলে ওর এভেইলেবেলেটিটা আমরা নিশ্চিত না।’ 

'অধিনায়কত্ব ও নেতৃত্ব আলাদা জিনিস। সিলেট টেস্টে শান্তর অধিনায়কত্ব দারুণ ছিল। কৌশলগত নিজের সেরা অবস্থানে ছিল। তার ফিল্ডিং সাজানো ছিল দারুণ। কখনো ভিন্ন কিছু চেষ্টা করেছে, যা ভীষণ কার্যকর হয়েছে। নেতৃত্ব ছিল দুর্দান্ত। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।’

- শান্তর অধিনায়কত্ব নিয়ে হাথুরুসিংহে

পাপন আরও যোগ করেন, ‘অবশ্যই ও আমাদের প্রথম পছন্দ অধিনায়ক হিসেবে সবসময়ই ছিল, এখনও আছে। দুর্ভাগ্যবশত যেহেতু একটা অনিশ্চিত রয়ে গেছে, এটার মধ্যে আমরা থাকতে চাচ্ছি না। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত আর দেরি করতে চাইনি। এখন থেকে বিশ্বকাপের খুব বেশি দেরি নেই, এই সময়ে যেন স্মুথলি দলটা চলতে পারে; সেজন্য এই নামটা আমরা ঘোষণা করে দিয়েছি।’

হাথুরুর চাওয়া ছিলেন শান্ত 

গেল বছর এশিয়া কাপের আগে আগে তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক হয়ে সাকিব ফিরলেও দলে তাকে পাওয়া নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। একেতো ক্যারিয়ারের শেষবেলা, তার ওপর ইনজুরি কিংবা রাজনীতির ব্যস্ততা। আর যে কারণে ভবিষ্যতের অধিনায়ক কে হচ্ছেন এ নিয়ে কম জল্পনা ছিল না। তবে সিলেটে শান্তর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ইতিহাসগড়া জয়ের পরপরই নিজের পছন্দটা জানিয়ে দিয়েছিলেন টাইগার হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহো। তিনি বলেছিলেন, 'অধিনায়কত্ব ও নেতৃত্ব আলাদা জিনিস। সিলেট টেস্টে শান্তর অধিনায়কত্ব দারুণ ছিল। কৌশলগত নিজের সেরা অবস্থানে ছিল। তার ফিল্ডিং সাজানো ছিল দারুণ। কখনো ভিন্ন কিছু চেষ্টা করেছে, যা ভীষণ কার্যকর হয়েছে। নেতৃত্ব ছিল দুর্দান্ত। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।’

ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসেবে শান্তকে দেখেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে হাথুরুসিংহে বলে, ‘আমার মনে হয় সামনে তার লম্বা সময় আছে। তার নেতৃত্ব ও অধিনায়কত্ব দেখে বোর্ড একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্তটা বোর্ডই নেবে। অবশ্যই তাকে নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চাই।’

ওই নতুনের কেতন ওড়ে

নতুন অধিনায়ক ও নতুন নির্বাচক প্যানেল-বাংলাদেশের ক্রিকেটে নব সূচনা বলা যেতেই পারে। নতুন নেতৃত্বের অভিষেক হতে যাচ্ছে ঘরের মাঠে আসন্ন শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে। চলতি বছরেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর বসবে আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে শান্তদের জন্য। 

তবে আশার বিষয় হচ্ছে, প্রতিবারের মতো বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে নয়, কিছুটা আগেভাগেই অধিনায়কত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে বিসিবি। এবার শান্তদের প্রমাণ করার পালা।

এফআই/জেএ