২৮ বছর পর জিল্লুর রহমান চম্পকের দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে শীর্ষ স্থানীয় দাবাড়ুরা একত্রিত হয়েছিলেন। ( বা দিক থেকে) তিন আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমান, আবু সুফিয়ান শাকিল ও জিল্লুর রহমান চম্পক। পেছনে গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ।

জিল্লুর রহমান চম্পক বাংলাদেশের দাবায় অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এক নাম। উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের পর বাংলাদেশে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) ছিলেন চম্পক। ১৯৯০ সালে আইএম হওয়া চম্পক ৯৪ সালে আমেরিকা প্রবাসী হন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২ নভেম্বর এসেছিলেন বাংলাদেশে। 

দুই যুগের বেশি সময় বাংলাদেশের দাবার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই চম্পকের। সুদূর আমেরিকায় থাকলেও বাংলাদেশের দাবার অনেক কিছুর সঙ্গেই তিনি জড়িত। দুইবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৬,'৮৭), দেশের দ্বিতীয় আইএম, তিনবার দাবা অলিম্পিয়াড খেলা দাবাড়ু। তাই তার ২৮ বছর পর আগমন দাবা অঙ্গনে বেশ আলোড়নই তুলেছে। কয়েকজন গ্র্যান্ডমাস্টার ও শীর্ষ স্থানীয় দাবাড়ুরা একত্রিত হয়েছিলেন তার আগমন উপলক্ষ্যে। 

ঢাকায় এসে চম্পকের স্মৃতিতে বারবারই ফিরেছে নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশে এসে তাই গ্র্যান্ডমাস্টার না হওয়ার আফসোস জেগেছে আবার তার কন্ঠে, ‘নিয়াজের পর আমিই ছিলাম দ্বিতীয় আইএম। চার-পাঁচ বছর (৮৭-৯১) নিয়াজের পর আমিই ছিলাম দেশের দ্বিতীয় সেরা দাবাড়ু। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সুযোগ ছিল, আসলে সেভাবে চেষ্টা করা হয়নি।’

নিয়াজ মোর্শেদ গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন ১৯৮৭ সালে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান হয়েছেন ২০০১ সালে। চম্পকের জিএম না হওয়ার ব্যাপারে জিয়ার পর্যবেক্ষণ ,‘জিএম হওয়ার জন্য আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় নির্বাচন সেভাবে করেছি। আরো অনেক পরিশ্রম ও পরিকল্পনা করতে হয়েছে। চম্পক ভাইয়ের দেশের দ্বিতীয় জিএম হওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি সেভাবে হয়তো এগোতে চাননি।’

জিল্লুর রহমান চম্পক বাংলাদেশের দাবায় অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এক নাম। উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদের পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) ছিলেন চম্পক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে অর্থনীতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন ১৯৯০ সালে। সেই বছরই দাবা আইএম টাইটেল পান। নিয়াজ ১৯৮৭ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর এবং জিয়ার আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার আগে চম্পকই ছিলেন দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মাস্টার। টাইটেল অনুযায়ী নিয়াজের প্রথম উত্তরসূরী চম্পকই। নিয়াজের প্রথম উত্তরসূরীকে পেছনে ফেলে জিয়া, রিফাত, রাকিব ও রাজীব জিএম হয়েছেন। ২০০৯ সালে রাজীব গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর চম্পকই পুনরায় একমাত্র আইএম হিসেবে থাকেন। ২০১১ সালে আবু সুফিয়ান শাকিল আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়ে চম্পকের কাতারে আসেন। এরপর ২০১২ এবং ১৯ সালে মিনহাজ উদ্দিন সাগর ও ফাহাদ রহমান আন্তর্জাতিক মাস্টার হন। 

চম্পক তার ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স হিসেবে বেছে নিলেন দুবাইয়ের টুর্নামেন্টকে ,‘এশিয়ান সিটিজ দাবায় বাংলাদেশ (ঢাকা দল) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই টুর্নামেন্টে আমি প্রথম বোর্ডের খেলোয়াড় ছিলাম। ওটা আমার ক্যারিয়ার এবং বাংলাদেশের দাবার বিশেষ অর্জন ’-বেশ তৃপ্তভাবে বলেন চম্পক। 

সেই টুর্নামেন্ট দিয়ে দাবায় জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের। তিন দশক আগের স্মৃতি স্মরণ করলেন জিয়া এভাবে, ‘এশিয়ান সিটিজ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ঢাকা এবং শাহজালাল দু’টি দল অংশ নিয়েছিল। ঢাকা দলে চম্পক ভাই ছিলেন প্রথম বোর্ডে আর আমি দ্বিতীয় বোর্ডে। সেই টুর্নামেন্টে ঢাকা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে তার অনেক অবদান। তিনি সেই সময় দুর্দান্ত দাবাড়ু ছিলেন।’

দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ চম্পক সম্পর্কে বলেন,‘আসলে আশির দশকে আমি দুরন্ত ফর্মে ছিলাম। একটানা কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি জাতীয় পর্যায়ে। ঐ সময় আমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো খেলোয়াড় আসলে সেই অর্থে ছিল না। চম্পকই সেই সময় আমার চ্যালেঞ্জার ছিল।’ 

আইএম হওয়ার পর দুই-তিন বছর বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেললেও জিএম নর্ম অবশ্য পাননি। এর মধ্যেই প্রবাস জীবনে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আমেরিকায় স্থায়ী হওয়ার আগেই কয়েকবার যাওয়া আসার মধ্যে ছিলাম। দাবায় ক্যারিয়ার সেভাবে ছিল না। তাই পরিবারের ঐক্যমতে যুক্তরাষ্ট্রেই যাওয়া হয়।’

দাবা এমন একটি খেলা অন্য দেশ থেকেও জিএম হওয়ার সুযোগ থাকে। প্রবাস জীবনে শুরুর দিকে দাবার সঙ্গে থাকলেও পরে আর জিএম হওয়ার চ্যালেঞ্জ রাখতে পারেননি,‘আমি যুক্তরাষ্টে কিছু প্রতিষ্ঠানের দাবা প্রশিক্ষক ছিলাম এবং কিছু আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম। নতুন দেশে নতুনভাবে সেটেল হওয়ার যুদ্ধে আর জিএম যুদ্ধে নামা হয়নি।’ 

আমেরিকার কয়েক শহর ঘুরে বাফেলোতে এক যুগের বেশি সময় স্থায়ী হয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনের অনেক তারকাই প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন। তাদের অনেকেই দেশে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন। কিংবদন্তি ফুটবলার এনায়েত দেশে ফিরেছিলেন ২৭ বছর পর। চম্পক আসলেন এরও বেশি সময়ের পর। দীর্ঘদিন পর আসার এই কারণ সম্পর্কে চম্পক বলেন,‘আমেরিকায় কিছু কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা সময় লেগেছে আবার সন্তানরাও সেখানে পড়াশোনা করেছে। সব মিলিয়ে দেশে দীর্ঘদিন আসা হয়নি।’

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দাবাড়ু চম্পক ২৮ বছর পর দেশে আসলেন। 

দেশে না আসলেও বাংলাদেশের দাবার খোঁজ রাখেন। দাবার একাল-সেকাল বিশ্লেষণ করলেন এভাবে,‘অনলাইনে পত্র-পত্রিকায় এবং দাবার অনলাইন প্লাটফর্মে খোঁজখবর রাখি। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আশি-নব্বইয়ের দশকে অনেক টুর্নামেন্ট হতো। এখন সেই মাত্রা কমে গেছে।’

এক মাসের কম সময় নিয়ে ঢাকায় সপরিবারে এসেছিলেন চম্পক। ২০ নভেম্বর আবার আমেরিকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। বিমানবন্দরে ফ্লাইটে উঠার আগ মুহূর্তে অসুস্থবোধ করায় তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে ভর্তি হন। কয়েক সপ্তাহ নিউরো সংক্রান্ত চিকিৎসায় খানিকটা সুস্থ হয়ে গতকাল আবার সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছিলেন। কিন্তু ফ্লাইট জটিলতায় আজ রাতে আবার ফ্লাইট পুনঃনির্ধারিত হয়েছে।

একনজরে বাংলাদেশের সফল দাবাড়ুরা
গ্র্যান্ডমাস্টার : নিয়াজ মোর্শেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আব্দুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব।
আন্তর্জাতিক মাস্টার : জিল্লুর রহমান চম্পক, আবু সুফিয়ান শাকিল, মিনহাজ উদ্দিন সাগর ও ফাহাদ রহমান।
নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার : রাণী হামিদ, শামীমা আক্তার লিজা ও শারমিন শিরিন।

এজেড/এফআই