বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবি
মিরপুর আর গামিনি যখন ব্যর্থতার বড় কারণ
ঘর নাকি নিজের সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং নিরাপদের জায়গা। অনেকের হিসেবে, ঘর থেকেই শিক্ষার শুরু। কিন্তু, প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট, তখন এই ঘরই যেন ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে সাফল্যের বাইরে আইসিসি ইভেন্টে বাংলাদেশ যেন নিজেদের চেনা ক্রিকেটই খেলতে ভুলে যায়। আর এর জন্য মিরপুরের মাঠকে দায়ী করা হলে, তাতে খুব বেশি অবাক করার কিছু থাকবেনা।
২০০৬ সালে উদ্বোধন করা হয় মিরপুরের শেরে-এ বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের। এরপর থেকে সেখানে ১১৭ ওয়ানডে, ২৬ টেস্ট আর ৬১ টি-টোয়েন্টি খেলা হয়েছে। এই সময়ে শেরে-এ বাংলা স্টেডিয়ামের চেয়ে বেশি খেলা হয়নি আর কোনো মাঠেই। আর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যের বড় একটা অংশ জুড়েই আছে এই স্টেডিয়াম।
বিজ্ঞাপন
তবে, প্রসঙ্গটা যখন বৈশ্বিক আসর, তখন মিরপুরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলাই যায়। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ধরাশায়ী হয়েছে ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই। আর সেখানে মিরপুরের দায় থেকেই যায়। বাংলাদেশ এমন পিচে খেলে অভ্যস্ত যেখানে প্রথম ইনিংসে গড় রান ২২০ এর নিচে। সর্বোচ্চ ২০১৬ সালে মিরপুরে গড় রান ছিল ২৬০। বর্তমানে যা ২১৯।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলেছে এমন কোনো মাঠেই প্রথম ইনিংসে গড় স্কোর এরচেয়ে কম নয়। ব্যতিক্রম ছিল কেবল ধর্মশালা। যেখানে প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর বিশ্বকাপে ছিল ২১৪। আর ওই মাঠেই কেবল দাপট দেখিয়ে ক্রিকেট খেলেছিল বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন
বিশ্বকাপে বাকি মাঠগুলোর মধ্যে পুনেতে প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ৩০৭, কলকাতায় ২৭৫, মুম্বাইয়ে ২৫১। বিশ্বকাপে এসব পিচে রান উঠেছে গড়ের চেয়ে বেশি। অরুণ জেটলিতে বিশ্বকাপের রেকর্ড ৪২৮ রান এসেছে। এইডেন মার্করাম এবং গ্লেন ম্যাক্সওয়েল দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড করেছেন। তবে, বাংলাদেশ দিল্লিতে খেলেছে এক ম্যাচ। সেখানেও রান করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে, সেখানে ম্যাচটা অন্তত জিতে এসেছিল তারা।
এবারে সার্বিক এক চিত্র দেখা যাক। ২০১৫ থেকে ২০২৩ এই তিন বিশ্বকাপের প্রথম ইনিংসের গড় হিসেব করলে দেখা যায় ২০১৯ বিশ্বকাপেই গড় রান কম এসেছে। ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম ইনিংসে গড় রান ২৮২। ২০১৯ বিশ্বকাপে প্রথম ইনিংসে গড় রান ছিল ২৪৭। আর ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৮১।
এদের মধ্যে ২০২৩ আসরে চারশ রান হয়েছে ৩ বার, ২০১৫ তেও ৩ বার চারশো রান দেখা গিয়েছিল। এবার ৩৯৯ রানে ইনিংস থেমেছে ২ বার। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ বিশ্বকাপে ৩০০ এর বেশি রান হয়েছে ৩০ বার। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৩০০শ এর বেশি রান এসেছে ২১ বার এবং ২০২৩ বিশ্বকাপে এরইমাঝে ২৩ বার ৩০০+ রান দেখা গিয়েছে।
স্লো এই পিচে মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদি হাসান মিরাজ কিংবা হাসান মাহমুদরা বরাবরই উজ্জ্বল। তবে, খেলা যখন স্পোর্টিং পিচে, তখন তারাই রীতিমত পাড়ার বোলার। বিশ্বকাপের ৯ ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের পেসাররা নিয়েছেন সবমিলিয়ে মাত্র ২৬ উইকেট। যা বিশ্বকাপের দলগুলোর মধ্যে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়
তবে মিরপুরের পিচে খেলে অভ্যস্ত বাংলাদেশ মানানসই নয় এমন ক্রিকেটে। যে কারণে বারবারই বড় স্কোরের সামনে বিব্রত হতে হয়েছে। নয়ত, নিজেরাই স্পোর্টিং উইকেটে খেই হারিয়েছে। আর বিশ্বকাপে এমন ব্যর্থতার পর খোদ জাতীয় দলেরই দুই ক্রিকেটার বলেছেন দেশের মাটিতেই স্পোর্টিং উইকেটের কথা।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে বিসিবির কাছে ভালো উইকেটের আবদার জানিয়ে রাখলেন শান্ত, 'অবশ্যই (আলাপ করা উচিত)। সবাই তো দেখলাম আমরা কী অবস্থায় আছি। আমরা যত খারাপ ব্যাট করেছি, অত খারাপ দল কিন্তু না। প্রস্তুতি ঠিক ছিল, ফল আসেনি। এটাই আশা করব, আমরা যখন হোয়াইট বল ফরম্যাট খেলার চেষ্টা করব ওয়ানডে হোক বা টি-টোয়েন্টি হোক, প্রত্যেকটা উইকেটই যেন ভালো হয় এবং স্পোর্টিং হয়।'
চোখ রাখা যাক বোলিং এর দিকে। মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে পেসার কিংবা চায়নাম্যান বোলারদের করার কিছুই থাকে না সে অর্থে। স্লো এই পিচে মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদি হাসান মিরাজ কিংবা হাসান মাহমুদরা বরাবরই উজ্জ্বল। তবে, খেলা যখন স্পোর্টিং পিচে, তখন তারাই রীতিমত পাড়ার বোলার। বিশ্বকাপের ৯ ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের পেসাররা নিয়েছেন সবমিলিয়ে মাত্র ২৬ উইকেট। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধুই আফগানিস্তান। তাদের উইকেট ২১। বাংলাদেশের পেসাররা বিশ্বকাপে করেছেন ২০৯.২ ওভার। প্রতি উইকেটের জন্য টাইগার পেসাররা খরচ করেছেন প্রায় ৫১ রান।
এমন ব্যর্থতার চিত্রে তাই উঠে আসে মিরপুরের পিচ কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার নাম। নিম্নমানের আর স্পিনিং উইকেট তৈরি করে বারবার মিরপুরকে যিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এমনকি এতে সায় আছে খোদ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের।
মিরপুরে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এমন স্পিনিং আর স্লো উইকেটের পক্ষেই সাফাই গেয়েছিলেন হাথুরু। হাথুরুর অধীনে ঘরের মাঠে কেমন ক্রিকেট খেলবে বাংলাদেশ, এমন প্রশ্নের উত্তরে হাথুরুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘ঘরের মাঠের সুবিধা বলে কি বোঝায়? যখন আমরা নিউজিল্যান্ড যাই, কি ধরনের উইকেটে খেলি? ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কি করে তাদের ঘরের মাঠে? ভারত এখন ঘরের মাঠে কি করছে?’
হাথুরুর এমন উত্তর, বছরের পর বছর ধরে গামিনির নিম্নমানের উইকেট তৈরি, মিরপুরের মাঠে অতিরিক্ত নির্ভরতা বৈশ্বিক মঞ্চে বারবারই পিছিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। কোচ বদল আর খেলোয়াড় সমালোচনার আড়ালে যে ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে বারবার।
জেএ