এমন দিন দেখবেন ভেবেছিলেন সাকিব?
সাকিব আল হাসান। দেশের তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেরই অন্যতম সেরা তিনি। দেশকে জিতিয়েছেন অনেক ম্যাচ, বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাপক সমাদৃত। অবশ্য নানা সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে কম সমালোচিতও হতে হয়নি তাকে। তবে সব যেন ছাড়িয়ে গেল এবার। বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে বিতর্কিত এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে দেশের একাংশের সমর্থকের চক্ষুশূল হন সাকিব। বিশ্বমঞ্চে নিজের বিবর্ণ পারফরম্যান্স ও দলের ভরাডুবি বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছে। সমালোচনার তির এখন সাকিবের দিকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাজে হারের পর গতকাল (বুধবার) মুম্বাই থেকে দল যখন কলকাতার বিমানে চড়ে বসে, সাকিব ততক্ষণে উড়াল দিলেন ঢাকার আকাশে। অধিনায়কের আচমকা দেশে ফিরে আসা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। খেলা চলাকালে বিজ্ঞাপন কিংবা দোকান উদ্বোধনে যোগ দেওয়ার বহু নজির আছে তার। যে কারণে এবারও তেমন কোনো উদ্দেশে ঢাকায় আগমন কি না, সেটি নিয়েই গতকাল দিনভর আলোচনা ছিল। যদিও পরে জানা যায়, শৈশবের গুরু ও কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছ থেকে নিজের ব্যাটিংয়ের ভুলগুলো যতটা পারা যায় শুধরে নিতেই ঢাকায় ফিরেছেন।
বিজ্ঞাপন
গত দুদিন ধরে মিরপুর শের-ই-বাংলায় অনুশীলনও করেছেন। দ্বিতীয় দিনে আজ মিরপুর ছাড়ার সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। ইনডোরে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের অনুশীলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে সমর্থকদের রোষের মুখে পড়েন সাকিব। 'ভুয়া ভুয়া' দুয়োধ্বনি ছুড়ে দেওয়া হয় সাকিবের প্রতি। এসময় একটি কালো রঙের গাড়িতে দ্রুত স্থানত্যাগ করেন টাইগার অধিনায়ক।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ট্রল বা কোনো একজন নির্দিষ্ট ক্রিকেটারকে টার্গেট করে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। তবে সাকিব আল হাসান আজ যে পরিস্থিতির মুখে পড়লেন, দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরাও বলছেন এটি নজিরবিহীন। এর আগে বহুবারই বিতর্কে জড়িয়েছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। জুয়ার বিজ্ঞাপন করে নিষেধাজ্ঞায়ও পড়েছেন। তবে কখনোই এভাবে সমর্থকদের একতরফা রোষের মুখে পড়তে হয়নি তাকে।
প্রতিবার যেমন হয়, বিশ্বকাপের আগে নানা নাটক ও থ্রিলার মঞ্চায়িত হয় দেশের ক্রিকেটে। আইসিসির বেধে দেওয়া শেষ সময়ে এসে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ও সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালকে বাদ দিয়েই দল ঘোষণা করা হয়। যা নিয়ে তোপের মুখে পড়ে বিসিবি। তামিমভক্তদের অভিযোগের আঙুল নতুন করে ওয়ানডে দলের দায়িত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসানের দিকেও ছিল।
পরে এক ভিডিও বার্তায় কারও নাম উল্লেখ না করেই তামিম জানান, ওপেনিং পজিশন ছেড়ে নিচে নেমে খেলার প্রস্তাবনা আসায় সরে গিয়েছেন তিনি। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের এক টিভি চ্যানেলে সাকিব সরাসরিই বলে দেন, দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না এমন খেলোয়াড় দলে প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তিনি। এরপর জল অনেকদূর গিয়েছে। যা কমবেশি সবাই জানেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ট্রল বা কোনো একজন নির্দিষ্ট ক্রিকেটারকে টার্গেট করে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। তবে সাকিব আল হাসান আজ যে পরিস্থিতির মুখে পড়লেন, এটি নজিরবিহীন। এর আগে বহুবারই বিতর্কে জড়িয়েছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। জুয়ার বিজ্ঞাপন করে নিষেধাজ্ঞায়ও পড়েছেন। তবে কখনোই এভাবে সমর্থকদের একতরফা রোষের মুখে পড়তে হয়নি তাকে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে দাপুটে জয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরুর পর মাঠের বাইরের বিতর্ক অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। এরপরই পথ হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। পথ হারান সাকিবও। বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ১৪ গড়ে সাকিবের রান মাত্র ৫৬, সর্বোচ্চ ৪০ রানের ইনিংস খেলেছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। পরিসংখ্যানই বলে দেয়, ‘ব্যাটসম্যান’ সাকিব তার সেরা ছন্দে নেই। বল হাতেও ওভারপ্রতি ৫.৫৪ রান দিয়ে এখন পর্যন্ত নিয়েছেন ৬ উইকেট। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে নেওয়া ৩০ রানে ৩ উইকেট তার ব্যক্তিগত সেরা। চোটের কারণে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি তো খেলতেই পারেননি।
এর মধ্যে বিশ্বকাপে ব্যাটিং অর্ডারে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে দলটাকে আরও নষ্ট করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ অনেকের। টাইগার অধিনায়ক কিংবা টিম ম্যানেজমেন্টের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তই নিজেদের পক্ষে যায়নি। বড় কিছুর স্বপ্ন নিয়ে ভারতে পাড়ি জমানো বাংলাদেশ এবার নিজেদের ইতিহাসে আরেকটা বাজে বিশ্বকাপ কাটানোর পথেই আছে হয়তোবা। এর মধ্যেই রানখরা কাটাতে ঢাকায় ফিরে অধিনায়ক শুনলেন ‘দুয়োধ্বনি’। কদিন আগেও যাকে ‘বাংলার জান বাংলার প্রাণ’ বলে সম্ভোধন করেছেন সমর্থকরা, তারাই এখন তাকে দুয়ো দিচ্ছেন।
অনেকে মনে করছেন হয়তো মাশরাফির পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন সাকিব। বাংলাদেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সেরা অধিনায়ক মাশরাফি। দীর্ঘদিন দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের শেষ তথা ২০১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন দলের ছায়া হয়ে। শোনা যায়, ফিট কিংবা ফর্মে না থেকেও অনেকটা জোর করেই খেলে গেছেন। সমালোচকরা এমনও বলেন, 'ক্যাপ্টেন কোটায় খেলছেন মাশরাফি', '১০ জন নিয়ে বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ'। বিশ্বকাপ শেষে বেশ বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে যান। দেশের কিংবদন্তিকে একপ্রকার জোর করেই দল থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়। সেই মাশরাফি এখনও অবসরের ঘোষণা দিতে পারেননি।
বছর ঘুরে ঘুরে আরও একটা বিশ্বকাপ। সাকিবও এখন ব্যাডপ্যাচে আছেন। ফর্মে ফিরতে ছুটে এসেছেন শৈশবের প্রিয় কোচের কাছে। সেখানে সমর্থকরা তাকে দেখে 'ভুয়া ভুয়া' বলে দুয়োধ্বনি দিয়েছে। সাকিব কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, খেলোয়াড়ি জীবনে এমন দিনও তাকে দেখতে হবে? গেল বিশ্বকাপের ক্যাপ্টেন নিয়ে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন সেটি তার দিকেও ছুটে যাবে, ভেবেছিলেন? তামিমের ইনজুরি নিয়ে মন্তব্য করে নিজেও ইনজুরির শিকার হবেন সেটিও নিশ্চয়ই ভাবেননি।
এক সমর্থক সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন, সাকিবের মতো বুদ্ধিমান মানুষের ক্যারিয়ারের অন্যতম বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে ওই ইন্টারভিউটা দেওয়া, যে ভুলটা রোনালদো বিশ্বকাপের আগমূহূর্তে পিয়ার্স মর্গ্যানকে দিয়ে করেছিলেন। বিশ্বকাপের প্রেসারের সাথে সাথে নিজের ওপরে বাড়তি প্রেসার নিয়ে এসেছেন দুইজনই, যার কারণে পারফর্মেন্সে প্রতিফলিত হচ্ছে। তবে সাকিব চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট। বারবার কামব্যাক করেছেন। এবারও তিনি দারুণভাবে কামব্যাক করুন, সেটাই প্রত্যাশা সবার।
এফআই