ঢাকায় অবিরাম বৃষ্টি ঝরেছে কয়েকদিন ধরে। শনিবার সকাল হতেই ঝিলিক দেওয়া রোদ হেসে ওঠে। একই সময়ে ভারতের ধর্মশালায় ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝেও দ্যুতি ছড়িয়েছে বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপ মিশনে নিজেদের প্রথম ম্যাচে টাইগাররা আফগানিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শুভসূচনা করেছে। যেখানে অধিনায়ক সাকিব ছিলেন আগ্রাসী মেজাজে; ব্যক্তিগত বোলিং থেকে শুরু করে দলের বোলিং পরিবর্তন ও ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দিয়ে ছাপ রেখেছিলেন পুরো ম্যাচজুড়ে।

মাঠে সাকিবের আগ্রাসী রূপ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটি আফগান ব্যাটার রহমানউল্লাহ গুরবাজের কণ্ঠেও শোনা গেছে। তার মতে, ‘সাকিব খুবই ভালো বোলার। পৃথিবীতেই অন্যতম সেরা সে। সব দলেরই সাকিবকে খেলতে সমস্যা হয়। যখনই সে ভালো বল করবে, আপনি যদি তাকে সম্মান না দেন সে উইকেট নেবে-ই।’

আর সাকিব যখন দলের পারফরম্যান্সে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, বাকিরাও তাকে অনুসরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। গতকালকের ম্যাচেও সেটাই দেখা গেছে বারবার। ম্যাচের শুরুতে আফগান দুই ওপেনার গুরবাজ এবং ইব্রাহিম জাদরান দাপট দেখাতে থাকেন। পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভের ঝড়— ব্যাট না নিয়ে কেন বোলিং নিলেন সাকিব! প্রতিপক্ষ যখন বড় সংগ্রহের পথে ছুটছে, তখনই বরাবরের মতো ব্রেক-থ্রু নিয়ে হাজির সাকিব। ম্যাচের আগের রাতেও অসংখ্য বার বলা সেই বাক্য-ই তখন কানে বাজছিল ‘শো-রুম’ কিংবা ‘বিজ্ঞাপন আল হাসান’। কিন্তু ম্যাচের মাঝামাঝিতে সেই নাম পরিণত হয় ‘শো-ম্যান’ আল হাসানে!

ইবরাহিম জাদরানকে তানজিদ তামিমের তালুবন্দি বানানোর মাধ্যমে শুরু। পরপর দুবারই তিনি ব্রেক-থ্রু এনে দেন টাইগারদের। যার শেষটা হয়েছে নাজিবুল্লাহ জাদরানের স্টাম্প ভাঙার মাধ্যমে। সবমিলিয়ে ৮ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩০ রান খরচায় ৩ উইকেট নেন সাকিব। যার সুবাদে বিশ্বকাপে স্পিনারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় সেরা তিনে উঠে এসেছেন। বিশ্বকাপে সাকিবের উইকেটসংখ্যা এখন ৩০ ম্যাচে ৩৭টি। এই তালিকায় পেছনে ফেলেছেন নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে। ৩২ ম্যাচে ৩৬ উইকেট রয়েছে সাবেক এই ক্রিকেটারের নামের পাশে। 

সাকিবের সামনে আছেন এখন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির (৪০ উইকেট) ও লঙ্কান কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরন (৬৮)। মুরালিধরনকে ছাড়িয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব হলেও ইমরান তাহিরকে পেছনে ফেলার দারুণ সুযোগ সাকিবের সামনে।

আফগানদের বিপক্ষে এদিন নিজের বোলিং কোটা পূরণ করেননি টাইগার অধিনায়ক। অথচ তার সামনেই যে পাঁচ উইকেট নেওয়ার সুযোগও ছিল! কিন্তু পরিসংখ্যান আর রেকর্ডের ধার না ধরা সাকিব সুযোগ দেন সতীর্থদের। এরপর মেহেদী মিরাজও ‘বড় ভাই’য়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেন তিন উইকেট।

সাকিবকে নিয়ে হরহামেশা অনেক বিতর্ক-ই দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হতে। সর্বশেষ বিশ্বকাপ দলে তামিম ইকবাল না থাকায় তার দিকে অভিযোগের তির ছুটেছে দর্শকদের। নানা সমালোচনার মুখে প্রতিবারই সাকিব জবাবটা দিয়েছেন মাঠের পারফরম্যান্স দেখিয়ে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচের আগেরদিন রাতে পায়ের ইনজুরিতে পড়ায় স্বদেশি সমর্থকদের বড় একটা অংশ আনন্দে ফেটে পড়েছিলেন। সেই সমর্থকগোষ্ঠীর মুখেও কাল ম্যাচশেষে প্রশংসা ঝরেছে সাকিবের। এমন পরিস্থিতির অভ্যাস অবশ্য সাকিবের আগে থেকেই ছিল!

বলের মতো অবশ্য ব্যাট হাতে খুব বেশি সফল বলা যাবে না সাকিবকে। দলের জয় থেকে ১১ রান দূরে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত ১৪ রান করে ফেরেন সাকিব। আউটের পরঅবশ্য  সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়েছেন সাকিব নিজে-ই। ভক্তদের চাহিদা ছিল জয়, যার ভিতটা তো সাকিব বল হাতে নিজেই গড়ে দিয়েছিলেন। 

এরপর বাকি থাকে দূরদর্শী নেতৃত্বের অংশ। ম্যাচে তানজিদ হাসান তামিম দারুণ ফিল্ডিং করেছেন। তার ফিল্ডিং সেট-আপও সেভাবেই করেছিলেন সাকিব। নিজের ওভারে শট কাভারে লিটনকে দাঁড় করিয়ে তামিমকে দেন লেগ থার্ড ম্যানে। ফলাফল– বাউন্ডারি খেলার নেশায় শট খেলা ইব্রাহিম জাদরান ক্যাচ আউট সেই তামিমের হাতে। এরপর ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজে যেমন উৎফুল্ল থেকেছেন, সঙ্গীদেরও করেছেন উজ্জ্বীবিত।

মিরাজ নিজে প্রথম ওভারে যখন নার্ভাস ছিলেন বল করতে এসে। সে সময় সাকিব সাহস দিয়েছেন, সঠিক জায়গায় রেখে বল করতে বলেছেন তিনি। তাই তো ম্যাচ শেষে অধিনায়ক সাকিবকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসান মিরাজ, ‘শুরুতে আমি একটু সতর্ক ছিলাম, তবে অধিনায়ক আমাকে ঠিক জায়গায় বল করতে বলেছিলেন। তিনি আমাকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বলেছিলেন এবং নিজের পারফরম্যান্সে মনোযোগ দিতে বলেছেন। যে কারণে কৃতিত্ব অধিনায়ককে দিতেই হয়।’

এদিকে ধর্মশালার মাঠ খেলার উপযোগী কিনা সে প্রশ্ন–ও এসেছে। কেননা মাঠের যে স্থানে ড্রাইভ দেওয়া হোক না কেন মাটি উপড়ে পড়তে দেখা গেছে। তবে সাকিব ড্রেসিংরুমে ফিরে জানিয়েছেন এসব অজুহাত হিসেবে না দেখতে, ‘আমরা কোনো অজুহাত দিতে চাই না যে মাঠ খেলার জন্য উপযুক্ত নয়। আমরা ড্রেসিংরুমে কথা বলেছি, পরিস্থিতি যেমনই হোক আমাদের মানিয়ে নিতে হবে।’

সাকিবের শো-রুম উদ্বোধন কিংবা বিজ্ঞাপন করার কথা আবারও কিছুটা তোলা যাক। মাঠের বাইরের শত ব্যস্ততার পরেও যদি মাঠের ক্রিকেটটাই শতভাগ দেওয়া যায় তাহলে সমস্যা কোথায়! সঙ্গীতশিল্পী তাসরিফ খান ম্যাচ শেষে একটা কথা বলেছেন, ‘সাকিব হচ্ছে ক্লাসের ফার্স্ট বয়-এর মতো। লেট করবে, ক্লাস মিস দিবে, ইতরামি করবে; কিন্তু দিন শেষে রেজাল্টে সব পোষায় দিবে।’

বাস্তবেও সাকিব তো আসলেই তাই। দিনশেষে বাংলাদেশ দলকে পুষিয়ে দেবেন। যে কারণে এই মানুষকে সাপোর্ট না করেও কি করে থাকবেন দর্শকরা! নিজের ‍উপস্থিতিতে-ই যিনি আবার মিরাজের মতো ব্যাক-আপ নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার প্রস্তুত করে দিয়ে যাচ্ছেন!

এসএইচ/এএইচএস