বাংলাদেশ জাতীয় দলের নতুন পেসার তানজিম হাসান সাকিব/ সংগৃহীত

কী অদ্ভুত সময় পার করলেন টাইগার ক্রিকেটের নতুন সংযোজন তানজিম হাসান সাকিব। শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার—এই চারদিনে জীবনের অনেক রং দেখা হয়ে গেল তার। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দুপুরে সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে ওয়ানডে ক্যাপ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় তার। ম্যাচের দিনটাও কাটে স্মরণীয়ভাবেই। তবে এরপরের তিনদিন তাকে সইতে হয়েছে ব্যাপক বিধ্বংসী এক ঝড়। যে ঝড়ে তাঁর ক্রিকেটার সত্তাও নড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। 

শুক্রবার নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম ওভারে তুলে নিয়েছিলেন রোহিত শর্মার উইকেট। ভারতের বিপক্ষে জয়ে মুখ্য অবদান ছিল তার। এমন পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে-দীনেশ কার্তিকরাও। 

জীবনের দারুণ এক শুক্রবার, জাতীয় দলে অভিষেক

ওয়ানডে ক্যাপ পরার বিশেষ মুহূর্তে 

শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর তিনটা। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে নিজের ওয়ানডে ক্যাপ পান তানজিম হাসান সাকিব। বোলার হিসেবে অভিষেক, তবে প্রথম মাঠে নামের ব্যাটার হিসেবে। ইনিংসের শেষে নেমে নিজেকে প্রমাণ করেন—খেলেন ৮ বলে ১৪ রানের ক্যামিও।

আরও পড়ুন>> ক্ষমা চাইলেন তানজিম সাকিব, বিসিবির সতর্কবার্তা

এরপর বোলার সাকিবের ভূমিকা। প্রত্যাশা ছিল বল হাতে দারুণ কিছু করবেন, করেছেনও তাই। প্রথম ওভারেই রোহিত শর্মার উইকেট তুলে নিয়েছেন। এরপর দারুণ এক ইনসুইংয়ে ফিরিয়ে দেন ফর্মে থাকা তিলক ভার্মাকে। তার এই ‘আরলি’ ২ উইকেট বাংলাদেশকে দেখায় জয়ের স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারের সমীকরণ জিতে তিনিই পাইয়ে দেন জয়।

প্রশংসার বন্যায় সাকিব 

তিলক ভার্মার উইকেট পাওয়ার পর

সাকিবকে আনা হয়েছিল ইনিংসের শেষ ওভারে। দরকার ছিল ১২ রান। সাকিব ডেথ ওভারের স্নায়ুচাপ সামলেছেন দারুণভাবে। দলকে এনে দিয়েছেন ৬ রানের অসাধারণ জয়। সেদিনই ভারতের কিংবদন্তি স্পিনার অনিল কুম্বলে বলেছিলেন— সে (তানজিম হাসান) দুর্দান্ত ছিল। আমার মনে হয় নতুন বলে গতিময় বোলিং করেছে, বেশ কয়েকটি ১৪০ কি.মি. এর চেয়ে বেশিও ছিল। সব ব্যাটারই তার বিপক্ষে ভুগেছে। নতুন বলে তার চেয়ে ভালো কেউ ছিল না। ডেথ ওভারেও সে ভালো করেছে, আমার মনে হয় খানিকটা চাপ ছিল কিন্তু সে ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার বল করেছে।

দীনেশ কার্তিকের মন্তব্য ছিল, তানজিম সাকিব লম্বা সময়ের জন্য দলকে সার্ভিস দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। 

বিতর্কের শুরু যেখানে 

ঘটনার সূত্রপাত ঘটে শনিবার সকালের পর থেকে। ফেসবুকে তানজিম সাকিবের বেশকিছু পুরোনো পোস্ট প্রকাশ্যে আসে সেদিন। ২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের সেই পোস্টে সাকিব নারীদের নিয়ে অন্য এক ব্যক্তির ধর্মীয় বক্তব্য হুবহু কপি-পেস্ট করেন। যেখানে লেখা ছিল—স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয় ইত্যাদি। 

স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়... 

আরও পড়ুন>> যে বিবেচনায় সাকিবকে ছাড় দিচ্ছে বিসিবি 

মূলত এই ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য নিয়েই সমালোচনার শুরু হয়। ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় বিতর্ক। তানজিম সাকিবের সমর্থন জানায় একটি পক্ষ। আরেক মহলের দাবি, নারী বিদ্বেষী এই ক্রিকেটারকে দল থেকে বাদ দেওয়া হোক। 

মৃত্যুঞ্জয়ের পোস্ট, সাকিবের অনঢ় অবস্থান 

নিজের এমন পোস্টের জন্য তানজিম যখন সমালোচিত তখন তার পাশে এসে দাঁড়ান জাতীয় দলের আরেক পেসার মোহাম্মদ মৃত্যুঞ্জয়। নিজের বন্ধুকে সমর্থন জানিয়ে দিয়েছেন পোস্ট। মৃত্যুঞ্জয় লেখেন— আমি সবাইকে আমার বন্ধুত্বের জায়গা দিই না। কারণ যে আখিরাতের জন্য কল্যাণকর নয় সে বন্ধু হতে পারে না। বন্ধু মনে রেখো, আমরা দুনিয়ায় কোনো মানুষকে খুশি করতে আসিনি আমরা শুধুই এসেছি আল্লাহকে খুশি করতে, তবে আমরা ভুলের উর্ধ্বে নই।

মৃত্যুঞ্জয়ের ফেসবুক পোস্ট

তানজিম সাকিব সেই পোস্টে নিজের অবস্থানে অনঢ় থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কমেন্টে লিখেছিলেন, তাকদীরের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমি তোমাকে আল্লাহর জন্যই ভালোবাসি বন্ধু। 

মাঝে শনিবার রাতেই নিউজিল্যান্ড সিরিজে দলে থাকার সুসংবাদ পেয়েছিলেন তানজিম সাকিব। তবে বিতর্কের মুখে সেই আলোচনা খুব বেশি বড় হতে পারেনি সেদিন। 

বিসিবির প্রথম বক্তব্য এবং তানজিমের ভুল স্বীকার 

পুরো বিষয় নিয়ে বিসিবি প্রথম মন্তব্য করেছিল ১৮ সেপ্টেম্বর সোমবার। বার্তা সংস্থা এএফপিকে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস বলেছেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’

এরপর মঙ্গলবার নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন তানজিম সাকিব। ভুল স্বীকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস। মঙ্গলবার মিরপুরে গণমাধ্যমের সামনে এই বিষয়ে কথা বলেন তিনি। জানান, তানজিম সাকিব কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এমন পোস্ট করেননি। সামনের দিনগুলোতে এই পেসারকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলেও জানান বিসিবির এই কর্মকর্তা। 

বিসিবির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন সাকিব

ভবিষ্যতে এমন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই কথাও নিশ্চিত করেন জালাল ইউনুস।

সবমিলিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ৯৬ ঘন্টাই হয়ত দেখে ফেলেছেন তানজিম সাকিব। আসছে নিউজিল্যান্ড সিরিজে এসব আলোচনা পাশ কাটিয়ে তিনি ঠিক কতটা সফল হন, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। 

জেএ