ছবি: সংগৃহীত

২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন তামিম ইকবাল। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৬ বছর ৫ মাস ২৬ দিন। যা ঘণ্টার হিসেবে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৮০। তাহলে আজ পর্যন্ত তামিমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স এটা? উত্তরটা হ্যাঁ, আবার না বললেও ভুল হবে না। কারণ মাঝে ২৮ ঘণ্টা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছিলেন না তিনি। সেক্ষেত্রে বছর আর মাসে পরিবর্তন না আসলেও দিন আর ঘণ্টার হিসেবে গরমিল হবে। তামিমের ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য হিসেব করতে গেলে এই ২৮ ঘণ্টা নিয়ে যেমন বিতর্ক হতে পারে, ঠিক তেমনি তার ক্যারিয়ারের সবেচেয়ে আলোচিত আর নাটকীয় সময়ও এই কয়েক ঘণ্টা।   

গত মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে হেরে ওয়ানডে সিরিজ শুরু করে বাংলাদেশ। আফগানদের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে ওয়ানডেতে হার অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে এক ম্যাচ হেরে যে জাত চলে গেছে ব্যাপারটা কিন্তু তেমনও না! তারপরও গণমাধ্যম থেকে চায়ের কাপ, সমালোচনা ছিল সব জায়গায়। অবশ্য সেই সমালোচনার কেন্দ্র-বিন্দুতে ছিলেন তামিম। কারণ ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেছিলেন, 'এটা বলব না যে, শতভাগ (ফিট আছি)। কিন্তু কালকে খেলবো।' পরের দিন কথা রেখেছিলেন তিনি। আর সেটাই যেন তার জন্য কাল হয়েছিল!

সমালোচনার মুখে ম্যাচের পরদিন (৬ জুলাই) দুপুর দেড়টা নাগাদ চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণা দেন তামিম। মনের মধ্যে থাকা ক্ষোভ কিংবা কষ্ট যাই বলা হউক না, তামিম যে স্বাভাবিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নেননি সেটা সংবাদ সম্মেলনে তার চোখই বলে দিয়েছিল। তবে সেদিন ব্যাক্তিগত কারণ দেখিয়েই ক্রিকেটার হিসেবে শেষবার সংবাদ সম্মেলনে বসেছিলেন তামিম। এরপর তার সঙ্গে একাধিক সোর্সের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কিন্তু তারপরও সম্ভব হয়নি। এমনকি তার বড় ভাই নাফিস ইকবালকে দিয়েও বার্তা পাঠান নাজমুল হাসান পাপন। তাতেও তামিম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি বিসিবি বস।

তামিম যখন রহস্যের দেয়ালে বন্দী তখন নাটকে আগমন ঘটে মাশরাফি বিন মর্তুজার। ৭ জুলাই মাশরাফির মধ্যস্থতায় তামিমকে গণভবনে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে দীর্ঘ আলোচনায় নিজের অবসরের কারণ ও পারিপার্শ্বিকতা ব্যাখ্যা করেন তামিম। সব শুনে তামিমকে আবারও ক্রিকেটে ফেরার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ২৮ ঘন্টার নাটক শেষে আবারও ক্রিকেটে ফেরেন তামিম। অবশ্য এই ২৮ ঘণ্টাকে নাটক না বলে ট্রেলার বলাই ভালো! কারণ পরের ২৮ দিনে যা ঘটেছে তা দিয়ে চাইলে একটা থ্রিলার সিনেমার স্কিপট লেখা যাবে!   

ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণার দিনই দেড় মাসের ছুটি নেন তামিম। তার মানসিক অবস্থা, আর পিঠের চোট সবমিলিয়ে এই সময়টুকু বিসিবিই বিবেচনা করেছে। এই ছুটিতে প্রথমে পরিবারের সঙ্গে দুবাইতে ঘুরতে যান তামিম। এরপর লন্ডনে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। সেখানে তামিমকে স্থায়ী সমাধান হিসেবে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তামিম ইনজেকশন নেন, যাতে করে সাময়ীকভাবে সুস্থ হয়ে আসন্ন এশিয়া কাপে খেলতে পারেন। 

লন্ডন থেকে ফিরে বিসিবির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তামিম, এটা আগে থেকেই জানা ছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানানো হয়নি। তারপরও বিসিবির বিভিন্ন সোর্স থেকে সংবাদকর্মীরা জানতে পারেন গতকালই বিসিবি-তামিম বৈঠক হবে।

শুক্রবার সারাদিনই ঢাকার আকাশে ছিল মেঘ-রোদের লুকোচুরি। এই বৃষ্টি ঝরেছে, তো পরক্ষণেই আবার উঁকি দিয়েছে সূর্য—চিলতে রোদে হেসেছে ব্যস্ততম নগরী। ঢাকার আকাশের মতোই রহস্যময় ছিল তামিম ইকবাল আর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গতকালের সভা। এই সভার বিষয়বস্তু অবশ্য জানাই ছিল সবারই। কিন্তু কোথায় বসছে তামিম-বিসিবি? এটা রীতিমতো শেন ওয়ার্নের গুগলির থেকে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে! কারণ এ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছুই জানানো হয়নি। অবশ্য সম্ভাব্য বেশ কয়েকটা লোকেশনেই আনা-গোনা ছিল সংবাদকর্মীদের। তার মধ্যে বিসিবি কার্যালয়, পাপনের বাসভবনসহ গুলশানের বেশ কয়েকটা হোটেল ছিল। কিন্তু তাদের এই দৌড়-ঝাপ বৃথা গেছে। কারণ সারা দিনেও তামিমের সন্ধান মেলেনি। 

অবশেষে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বিসিবি সূত্রে জানা যায়, রাত ৮টায় তামিম ইস্যুতে ব্রিফিং করবেন পাপন। লোকেশন- বিসিবি বসের গুলশানের বাসভবন আইভী কনকর্ড। তখন থেকেই ক্যামেরার লেন্সে আইভী কনকর্ডকে নিশানা বানিয়ে অপেক্ষায় সংবাদকর্মীরা। সন্ধ্যা ৭টা ৪১ মিনিটে সেখানে প্রবেশ করে কালো গ্লাসের কমলা রঙের একটি গাড়ি। তাতে বাইরে থেকে দেখেই বুঝা গেছে, ভেতরে বসা তামিম। ওয়ানডে অধিনায়ককে কত শতবার সামনে থেকে দেখেছেন এই সংবাদকর্মীরা তারপরও আজকের এই তামিমের দেখা পাওয়াট কেন যেন বিশেষ মনে হয়েছে! তাদের চোখ সে কথাই বলছিল! যেন তপ্ত দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি! অথচ তামিমের মনে তখন মরুর তপ্ত হাওয়া বইছে! 

গাড়ি থেকে নেমে সোজা হাঁটা দিয়ে বাসার ভেতর ঢুকেন তিনি। যেন শত ব্যস্ততা তার! তামিমের আসার আগেই অবশ্য আইভী কনকর্ডের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন ক্রিকেট অপরারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস চৌধুরী। এই দুইজনের পর রাত ৮টা ১৫ মিনিটে আলোচনায় যোগ দেন পাপন। শুরু হয় তিনজনের রুদ্ধদ্বার বৈঠক! 

প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলে তাদের এই আলোচনা। সভা শেষে রাত ৯টা ২৭ মিনিটে পাপনের বাসভবনের গ্যারেজে যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। শুরুতেই কথা বলেন তামিম, ‘আমার চোট একটা সমস্যা, যে ইনজেকশনটা নিয়েছি ওটা অনেকটা হিট অ্যান্ড মিসের মতো। আমার কাছে মনে হয় যে দল আগে, দলের কথা চিন্তা করে আমার নেতৃত্ব ছাড়াটা সবচেয়ে ভালো বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি বুঝেছেন।'

এই কয়েকটা লাইনের সারমর্ম হলো, তামিম ওয়ানডে অধিনায়ক থাকছেন না। কিন্তু তিনি খেলবেন। আচ্ছা এবার আরেকবার পেছন ফিরে দেখা যাক। আজ থেকে ২৮ দিন আগে তামিম ক্রিকেট থেকেই অবসর নিয়েছিলেন, এবার শুধু নেতৃত্ব ছাড়লেন।

এশিয়া কাপের বাকি আছে আর ২৬ দিন। পাপনের কথা মতো, কালকে বিকেলেও বিসিবির পরিকল্পনায় অধিনায়ক ছিলেন তামিম। এমনকি অস্ত্রোপচার না করে ইনজেকশন নেওয়ারও বড় একটা কারণ ছিল এই আসরে খেলা। কিন্তু শেষ সময়ে এসে নতুন অধিনায়ক নিয়ে এশিয়া কাপে খেলাটা কি চ্যালেঞ্জের না? অথচ তামিম বলেছেন, 'মূল বিষয় হলো দলের ভালোর জন্য আমি নেতৃত্ব ছাড়ছি; একজন ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে চাই।’

২৮ দিনের আগে-পরের দুটো ঘটনা পাশপাশি রাখলে একটা জায়গায় মিল পাবেন— তামিমের অবসর কিংবা অবসর ভেঙে ফেরা দুটো সিদ্ধান্তই অপ্রত্যাশিত।

এইচজেএস