শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে যখন ম্যাচ জমিয়ে তুলছিল আয়ারল্যান্ড, তখন চেমসফোর্ডের আকাশে মেঘের আগমন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটা বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে। এর ফলে ১৭তম ওভারের তৃতীয় বলের পর খেলা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি বাধায় ম্যাচের ফলও থাকল অমীমাংসিত। 

চেমসফোর্ডে টস হেরে শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৪৬ রান সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৬১ রান করেন মুশফিকুর রহিম। ৬১ রানে ৩ উইকেট শিকার করে ইনিংসের সেরা বোলার জস লিটল। জবাব দিতে নেমে বৃষ্টির আগে ১৬ ওভার ৩ বল শেষে আয়ারল্যান্ডের সংগ্রহ ছিল ৩ উইকেটে ৬৫ রান। 

আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ওয়ানডে ম্যাচের ফল নির্ধারণের জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে অন্তত ২০ ওভার খেলা মাঠে গড়াতে হবে। যেহেতু আয়ারল্যান্ডের ইনিংসে ২০ ওভার খেলা সম্পন্ন হয়নি, তাই এই ম্যাচে বৃষ্টি আইন (ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতি) কার্যকর হয়নি। ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ডের তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। তবে ওয়ানডে সুপার লিগের শেষ সিরিজ হওয়ায় কার্যত লড়াইয়ে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। বাংলাদেশ ও আয়োজক ভারতসহ সাত দলের ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সরাসরি খেলা আগেই নিশ্চিত হওয়ায় এ সিরিজটি টাইগারদের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে মহাগুরুত্বপূর্ণ ছিল আয়ারল্যান্ড ও প্রোটিয়াদের জন্য। এক আসনের জন্য লড়াইয়ে থাকা দুই দলের একদল আইরিশরা আজ ছিটকে গেল রেস থেকে। 

অবশ্য অষ্টম দল হিসেবে ভারত বিশ্বকাপে সরাসরি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে তিন ম্যাচই জিততে হতো আন্ড্রো বালবার্নির দলকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অন্তত এক ম্যাচ জিতলেই বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত হতো প্রোটিয়াদের। প্রথম ওয়ানডেতে বৃষ্টি কপাল পুড়ল আইরিশদের।

আয়ারল্যান্ডসহ সুপার লিগের নিচের পাঁচ দল শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে ও নেদারল্যান্ডসকে খেলতে হবে বাছাইপর্ব। যেখান থেকে অক্টোবর-নভেম্বরের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে দুই দল। 

মঙ্গলবার (৯ মে) চেমসফোর্ডে বাংলাদেশের দেওয়া ২৪৬ রানের মাঝারি মানের লক্ষ্য তাড়ায় ধীরগতির শুরু করেন দুই আইরিশ ওপেনার পল স্টার্লিং ও স্টিফেন ডোহেনি। তবে ইনিংসের প্রথম ওভারেই দারুণ সুযোগ তৈরি করেছিলেন হাসান মাহমুদ। পঞ্চম বলটি ব্যাটে খেলতে পারেননি ডোহেনি, তার প্যাডে আঘাত হানে। তাতে হাসানের আবেদনে সাড়া দিয়ে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। কিন্তু এ যাত্রায় রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান ডোহেনি।

তবে আইরিশদের ওপেনিং জুটি ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি বাংলাদেশি বোলারদের। চতুর্থ ওভারের তৃতীয় বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে গুড লেন্থে করেছিলেন শরিফুল, সেখানে কাট করতে গিয়ে ব্যাকওয়াড পয়েন্টে মিরাজের হাতে ধরা পড়েন স্টার্লিং। তার আগে ১৫ রান এসেছে এই ওপেনারের ব্যাট থেকে। 

চেমসফোর্ডের পেসবান্ধব উইকেটে ইনিংসের প্রথম বল থেকেই আক্রমণাত্মক বোলিং করেছেন হাসান মাহমুদ। তবে উইকেটের দেখা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১২ বল। নিজের দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলটি ফুল লেন্থে রেখেছিলেন হাসান, তাতে ব্যাট চালিয়ে বোকা বনে যান অ্যান্ড্রো বার্লবির্নি। তার প্যাড আর ব্যাটের ফাঁক গলে বল আঘাত হানে তার স্টাম্পে। সাজঘরে ফেরার আগে পাঁচ রান করেছেন বার্লবির্নি।

এরপর আক্রমণে এসে নিজের দ্বিতীয় ওভারেই উইকেটের দেখা পেয়েছেন তাইজুল ইসলাম। ইনিংসের ১৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে এই স্পিনারের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ১৭ রান করা ডোহেনি। শুরুর বিপর্যয় কাটিয়ে যখন ম্যাচ জমিয়ে তুলছিল আয়ারল্যান্ড, তখন চেমসফোর্ডের আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি শুরু।

এর আগে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতে ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। আইরিশদের হয়ে বল হাতে ইনিংস ওপেন করা জস লিটল প্রথম ওভারেই বেশ ভুগিয়েছেন বাংলাদেশি ব্যাটারদের। নতুন বলে এই পেসারের বাড়তি সুইং আর পেস সামলাতে পারেননি লিটন। ইনিংসের চতুর্থ বলটি অফ স্টাম্পের ওপর ইয়র্কার করেছিলেন লিটল, সেখানে সোজা ব্যাটে ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে করতে পারেননি লিটন। তাতে বল আঘাত হানে তার প্যাডে। আর আম্পায়ার তাতে আঙ্গুল তুলতে খুব একটা সময় নেননি। 

লিটনের বিদায়ের পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তামিম ইকবালও। যদিও শুরুটা ভালোই করেছিলেন এই ওপেনার। দুই বাউন্ডারিতে ভালো শুরুর আভাস দিয়েও থিতু হতে পারেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক। চতুর্থ ওভারের পঞ্চম বলটি অফ স্টাম্পের অনেকটা বাইরে ফুলার লেন্থে করেছিলেন মার্ক অ্যাডায়ার। সেখানে বড় শট খেলতে গিয়ে তামিমের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল চলে যায় উইকেটকিপার লরকান টাকারের গ্লাভসে। তাতে আউটের আবেদন করেন আইরিশরা। কিন্তু আম্পায়ার তাতে সাড়া দেননি। ফলে রিভিউ নেয় তারা। তাতে সিদ্ধান্ত বদলে আউট দিত্যে বাধ্য হন আম্পায়ার। 

দুই ওপেনারের বিদায়ের পর দলের হাল ধরেন সাকিব আল হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত। তাদের দৃঢ়তায় দলীয় অর্ধশতক পূরণ করে বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুর পাওয়ার প্লে শেষে আর বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না সাকিব। ১২তম ওভারের প্রথম বলে গ্রাহাম হিউমকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ব্যাটে বলে করতে পারেননি সাকিব। তাতে বল সরাসরি আঘাত হানে তার উইকেটে। সাজঘরে ফেরার আগে ২১ বলে ২০ রান করেছেন এই অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার।

সাকিব ফিরে যাওয়ার পরও দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন শান্ত। শুরুতে কিছুটা ধীরগতির ব্যাটিং করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এই টপ অর্ডার ব্যাটার। হৃদয়ের সঙ্গে চতুর্থ উইকেট জুটিতে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ব্যাক্তিগত হাফ সেঞ্চুরির খুব কাছেই ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর মাইলফলক ছুঁতে পারেননি। ২২তম ওভারের চতুর্থ বলে কুর্টিস ক্যাম্পারকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানায় অ্যাডায়ারের হাতে ধরা পড়েন শান্ত। ৭ চারে ৬৬ বলে ৪৪ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে।

দেশের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজে দুর্দান্ত খেলেছিলেন তাওহিদ হৃদয়। নিজের অভিষেক সেই সিরিজের ফর্ম টেনে নিতে পারলেন না ইংল্যান্ডে। আইরিশ পেসারদের সামলে উইকেটে থিতু হলেও ইনিংস বড় করতে পারলেন না এই তরুণ ব্যাটার। ২৭তম ওভারের তৃতীয় বলটি অফ স্টাম্পের বাইরেফুল লেন্থে করেছিলেন গ্রাহাম হিউম। এই পেসারকে ডিফেন্স করতে গিয়ে আউট সাইড এইডজে ধরা পড়েন হৃদয়। উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়েছেন লরকান টাকার। সাজঘরে ফেরার আগে ৩১ বলে ২৭ রান করেছেন হৃদয়।

১২২ রানে পঞ্চম উইকেট হারানোর পর দায়িত্ব বেড়ে যায় মিরাজের। সেটার ছাপও ছিল তার ব্যাটিংয়ে। অভিজ্ঞ মুশফিকের সঙ্গে দেখে-শুনেই খেলছিলেন এই তরুণ অলরাউন্ডার। কিন্তু হঠাৎ মাথা গরম করে বআইপড ডেকে আনেন তিনি! ৩৮তম ওভারের তৃতীয় বলে জর্জ ডকরেলকে স্লগ সুইপ করেন মিরাজ। কিন্তু ব্যাটে-বলে ঠিকমতো টাইমিং না হওয়ায়  এইডজ হয়ে বল ওপরে উঠে যায়। তাতে ধোহেনির হাতে ধরা পড়েন ২৭ রান করা মিরাজ। 

জন্মদিনে খেলতে নেমে ট্যাক্টরের কাছ থেকে যেন উপহার পেলেন মুশফিক! ৩১তম ওভারের চতুর্থ বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে লেন্থ ডেলিভারী ছিল, মুশফিক কাট করার পর হাওয়া ভাসতে ভাসতে বল চলে যায় ব্যাকওয়াড পয়েন্টে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যারি ট্যাক্টর জায়গায় দাঁড়িয়ে বলের নাগাল পেলেও হাতে জমাতে পারেননি। তাতে ১৯ রানে জীবন পান মুশফিক। এরপর ৬৩ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার ব্যাট থেকে এসেছে সর্বোচ্চ ৬১ রানের ইনিংস। যা এই মাঠে ওয়ানডেতে কোনো ব্যাটারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত ইনিংস।

৪৫তম ওভারে মুশফিক ফিরে গেলে অলআউটের শঙ্কায় পরে বাংলাদেশ। তবে শেষদিকে তাইজুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলামের ব্যাটে ভর করে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৪৬ রান তুলেছিল তামিমের দল।

এফআই/কেএ