যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে- এই প্রবাদের গভীরতা বিশাল। আর এই বিশাল বলার কারণও নিশ্চয়ই রয়েছে। আমাদের সবার পরিবারেই মা-স্ত্রী-দাদী কিংবা বোনসহ অন্যান্য নারীরা রয়েছেন। যারা পরিবারের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে থাকেন। বলা হয়ে থাকে একজন পুরুষের জীবনে সফলতার পেছনে রয়েছে একজন নারীর অবদান। যা অধিকাংশ পুরুষই স্বীকার করে থাকেন।

বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও বড় বড় তারকাদের মায়ের সঙ্গে মঞ্চে উঠে পুরস্কার সংগ্রহ করে সেটা মাকে উৎসর্গ করতে দেখা যায়। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কিংবা বিরাট কোহলিরা সবসময় তুলে ধরেছেন তাদের জীবনে মায়ের অবদানের কথা।   

তবে ঘরের বাইরেও নারীরা এখন কর্মক্ষেত্র বা অন্যান্য সবখানেই নিজের প্রতিষ্ঠার ছাপ রেখে চলেছেন। এই ধরুন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়কের কথা। কত ঝড়-ঝাপটাকে পাশ কাটিয়ে নিগার সুলতানা জ্যোতি এখন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন বিশ্বের দরবারে। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের সম্মান জানিয়েই বিশ্বের সব দেশেই দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

আর এই দিবসে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির। জ্যোতি জানিয়েছেন তার জীবনে মা-বোনের অবদানসহ ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটাও।

আরও পড়ুন : ‘ক্রীড়াঙ্গনে অগ্রযাত্রায় পথ দেখাচ্ছেন নারীরা’

প্রশ্ন : জন্ম বেড়ে উঠা কিংবা ক্রিকেটের সঙ্গে আপনার পরিচয় কিভাবে হয়েছিল?

জ্যোতি : শেরপুরে আমার জন্ম, এখানেই বেড়ে উঠেছি। এমনকি ক্রিকেট শেখাও এখান থেকেই। আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন থেকেই ক্রিকেট খেলা শুরু করি। যখন হাঁটতে পারি তখন থেকেই ক্রিকেট খেলা শুরু আমার। মেইনলি আমার বড় ভাইদের দেখেই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা শুরু। তখন থেকে ক্রিকেটের প্রতি আমার নেশা বাড়তে থাকে। অন্য মেয়েদের মতো আমার মেয়েলি খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল না। ক্রিকেট দেখছি ছোট থেকে সে কারণেই ক্রিকেটের প্রতি ভালোলাগা।

প্রশ্ন : ক্রিকেটার হওয়ার শুরু থেকেই কি পরিবার থেকে সাপোর্ট পেয়েছিলেন? 

জ্যোতি : আমার পরিবার থেকে সবসময়ই সাপোর্ট ছিল। তবে প্রথম দিকের দুই একজন আত্মীয়-স্বজন বিষয়টি পজিটিভভাবে নেননি। কারণ আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। তাদের স্বপ্ন ছিল হয়তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা এমন কিছু বানানোর। সে কারণে তারা প্রথমদিকে একটু নিরাশ ছিল যে মেয়েটাকে দিয়ে ক্রিকেট খেলাচ্ছেন, পড়াশোনায় ভালো ক্যারিয়ার হতে পারত, এখন নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার পরিবার সবসময় আমার পাশে ছিল। এরপর যখন জাতীয় দলে খেলি,তখন আবার আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যেকে খুব ভালো সাপোর্ট দিতে থাকেন। তবে প্রথম থেকে পরিবারের সাপোর্ট পাওয়ায় আজকে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি।

প্রশ্ন : ক্রিকেটার না হলে কি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন বা পরিবার কি চাইতো?

জ্যোতি : আসলে পড়ালেখায় ভালো ছিলাম তো, সে কারণে সবার চাওয়া থাকত ডাক্তার হই। যদিও পরবর্তীতে এখন ক্রিকেটারই হয়েছি (হাসি)।

প্রশ্ন : একসময় যারা আপনার পেছনে কথা বলত, তারাই এখন সুনাম করে; ব্যাপারটা কেমন লাগে?

জ্যোতি : না, ভালো লাগে আসলে। আর এখন তো সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। যখন অবস্থান পরিবর্তন হয়, তখন তো অটোমেটিক সবকিছুই পরিবর্তন হবে।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই জ্যোতিকে সাপোর্ট দিয়ে যান মা

প্রশ্ন : মেয়ে হয়েও ক্রিকেটার থেকে এখন জাতীয় দলের অধিনায়ক, জার্নিটা কতটা আপনার এবং পরিবারের জন্য কতটা কষ্টের ছিল?

জ্যোতি : আমার মা-বাবাকে তো অনেক বাজে মন্তব্য সইতে হয়েছে। মেয়েকে দিয়ে ক্রিকেট খেলাচ্ছেন, মেয়ের ভবিষ্যত কী হবে। তবে আমার বাবা-মা খুবই পজিটিভ ছিলেন। সত্যি কথা বলতে, আমার আম্মা ছিলেন অনেক স্ট্রং মনের মানুষ। ওনি কখনোই এসব বিষয় আমার মাথায় আনতে দিতেন না। সবসময় বলতেন তোমার ভালালাগার বিষয় এটা, তুমি চালিয়ে যাও। আমাদের সাপোর্ট আছে, কে কী বলল বা পেছনে কী কথা হচ্ছে তাতে কান দিয়ো না। তুমি তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে যাও।

প্রশ্ন :  আপনার জীবনে মায়ের পরে কোন নারীর অবদান বেশি?

জ্যোতি : অবশ্যই আছে, আমার বড় আপু স্পেশালি। কারণটাও বলে দিই। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কাজে আমি ব্যস্ত থাকতাম, বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে খেলার জন্য। সেক্ষেত্রে দেখতাম আমার ব্যাগ বা অন্যান্য জিনিসগুলো আপু গুছিয়ে রাখতেন। মানসিক সাপোর্ট বলেন বা পড়াশোনার বিষয়েও সাহায্য করতেন তিনি। আমি তো স্কুল-কলেজে অন্যদের মতো থাকতে পারতাম না। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যেসব নোট লাগত সেগুলো আপু সবকিছু নিয়ে আসতেন। এছাড়া পারিবারিক বিষয়ও তিনিই হ্যান্ডেল করতেন।

মায়ের পর বোনের কাছ থেকে জ্যোতি সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছেন

প্রশ্ন : আপনি যেহেতু অধিনায়ক, সে কারণে দলের সবকিছু আপনাকে সামলাতে হয়। তার মধ্যেও জুনিয়রদের আগলে রাখেন, সবশেষ পেসার মারুফার সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি সবার নজরে এসেছিল, এ বিষয়ে যদি বলতেন?

জ্যোতি : আমার চেষ্টা থাকে সবসময়। যখন একজন খেলোয়াড় দলে নতুন ঢোকে, সে অনেক বেশি একাকী বোধ করে এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ যখন একটা টিমে যখন অনেক বছর ধরে কয়েকজন খেলোয়াড় একত্রে খেলেন, তাদের মধ্যে হঠাৎ নতুন একজন খেলোয়াড়ের মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। এটা শুধুমাত্র যে ক্রিকেটে সেটা নয়, সব ক্ষেত্রেই এমন হয়। নতুন পরিবেশে গেলে কিন্তু মানিয়ে নিতে কষ্ট হবেই। আমার বা দলের সঙ্গে নতুন সেই খেলোয়াড়ের রাস্তাটা আমি সহজ করে দিতে চেষ্টা করি সবসময়। কারণ একজন নতুন খেলোয়াড় বা জুনিয়রকে যখন অন্যদের সঙ্গে দ্রুত পরিচয় করিয়ে দিতে পারব, ততই দলের জন্য ভালো। সেজন্য আমি সবসময় চেষ্টা করি জুনিয়র যারা আছে তারা যেন কমফোর্ট ফিল করে। অনেকে লজ্জাবোধ করে, আবার অনেকে ভয় পায় কী বললে কী হবে এসব ভেবে। আমি ওই রাস্তাটা সহজ করে দিই আর কি!

প্রশ্ন : আজ নারী দিবস। আপনার অনেক ভক্ত আছেন, যারা আপনাকে আইডল মেনে ক্রিকেটে আসতে চায় সে সকল নারীদের উদ্দেশে কি বলবেন?

জ্যোতি : প্রথমত, যদি কোনো লক্ষ্য স্থির করা থাকে যে আমি কিছু করতে চাই; সে লক্ষ্যে অটুট থাকাটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। এ ক্ষেত্রে নেগেটিভ কথা আসবে, সেগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াটাই হতে হবে মূল লক্ষ্য। আমি একজন নারী হিসেবে মনে করি মানসিকভাবে যত শক্তিশালী থাকা যাবে, ততই সবকিছু আয়ত্ত করতে সহজ হবে। কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের জন্য এখনও সবকিছু সহজ হয়ে যায়নি।

এসএইচ/এএইচএস