ছবির মতো সাজানো-বিশেষণটা বহু ব্যবহারে পুরোনো। তারপরও অ্যাডিলেড ওভালের আঙিনায় পা রেখে মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়েই গেল! ওয়েমাউথ স্ট্রিট থেকে হাঁটা পথে সকালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হৃদয় বলে পরিচিত স্টেডিয়ামটিতে পা রাখতেই মনটা কেমন যেন ভাল হয়ে উঠল!

আগের দিন যখন ব্রিসবেন থেকে অ্যাডিলেডে পা রেখেছিলাম, তখন ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে ঝরছিল বৃষ্টি। বৃষ্টির কণা শরীরে এসে কাঁটার মতো বিঁধছিল! 

কী আশ্চর্য সকাল হতেই হেসে উঠল আকাশ। ঘুম ভাঙতে হোটেল রুমের জানালার পর্দার ফাক গলে বিছানায় পড়ল এক ফালি রোদ‍! কিন্তু রুম ছেড়ে বেরোতেই গিয়ে বুঝতে পারলাম-রোদ উঠলেও শীত কমেনি। সিডনি-ব্রিসবেনের গরম কাপড় গায়ে দিতেই হয়নি। কিন্তু এখানে সে উপায় নেই মোটেও। 

সেই হিম ঠাণ্ডা সঙ্গী করেই সকাল গড়াতেই চলে এসেছি অ্যাডিলেড ওভালে। বাইরে যেন একটা পিকনিক পিকনিক আমেজ! অবশ্য এই ওভাল শুধু ক্রিকেট মাঠই নয়, আরও অনেক আয়োজনের মিলন মেলা! যার ইতিহাসটাও অনেক অনেক পুরোনো। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণের শহর অ্যাডিলেড এই মাঠের পথচলা সেই ১৮৭১ সালে। 

একেবারে শহরের কেন্দ্রে অ্যাডিলেড পার্কল্যাণ্ডে এই মাঠটি। পাশেই বিশাল এক লেক। যেখানে নানা জাতের পাখির কিচির-মিচির শব্দে মনটা ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। তবে যেমনটা বলছিলাম-শুধু ক্রিকেট নয়, এখানে অস্ট্রেলীয় রুলস ফুটবলটাই বেশি হয়ে থাকে। রাগবি লিগ, রাগবি ইউনিয়ন ম্যাচ ঘিরেও উন্মাদনার কমতি নেই। সঙ্গে কনসার্টের আয়োজন তো থাকেই! অ্যাডেলে, গানস এন রোজেস, রোলিং স্টোনস কে না গেয়েছে এখানে!

মজার ব্যাপার হলো নামের দিক থেকে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড এগিয়ে থাকলেও দর্শক ধারণ ক্ষমতায় এগিয়ে অ্যাডিলেড ওভালই।  ২০০৬ সাল অব্দি এখানে দর্শক ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩৬,০০০। তারপর অস্ট্রেলীয় রুলস ফুটবলকে অ্যাডিলেডে ফিরিয়ে আনতে ৫৭৫ মিলিয়ন ডলারে ফের কিছু সংস্কার করা হয় মাঠে। আর এখন তো দর্শক ধারণ ক্ষমা ৫৪ হাজার! যেখানে সিডনি ৪২ হাজার। 

এখন রাগবি-ইউনিয়ন ফুটবলের ব্যস্ততা থাকলেও এখানে দাপটে ক্রিকেটটাও হয়ে থাকে! বিশেষ করে অ্যাশেজ ম্যাচ থাকে নিয়মিত। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই মাঠে টাইগারদের দুটো ম্যাচ-ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে। 

এমনিতে অ্যাডিলেড শহরটি খেলাধুলা, শিল্পকলা আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ভরপুর এক জায়গা। আধুনিকতা এবং ঐতিহ্য দুটোরই দেখা মেলে শহরের প্রতিটি অলিতে-গলিতে। সকালে হাঁটতে গিয়ে তারই ছাপ দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছিল অতীতকে ওরা যেমন ভুলে যায়নি আবার বর্তমান আর আধুনিকতাকেও ফেলে দেয়নি!

আর অ্যাডিলেড ওভালকে সাজানো হয়েছে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হৃদয়ের মতো করে। এখানেই বিশ্বখ্যাত ব্র্যাডম্যান কালেকশন মিউজিয়াম। সুযোগ পেলে সেখানেও ঢু মারার ইচ্ছে আছে সামনের দিনে। শুধু কি সুনাম? সঙ্গে অনেক যন্ত্রণাও তো আছে এই মাঠের! ১৯৩২ সালে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বডিলাইন সিরিজের টেস্টে। যেখানে রেকর্ড ৫০,৯৬২ দর্শকের সামনে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে আটকাতে ইংলিশ বোলার হ্যারল্ড লারউডের সেই শরীর বরাবর আক্রমণের কথা তো এখনো ক্রিকেটের অন্ধকার সময়ের সাক্ষী হয়েই আছে!

কিন্তু অ্যাডিলেড ওভাল নামটা সামনে আসলেই বাংলাদেশ দল আর টাইগার সমর্থকরা নিশ্চিত করেই চনমনে হয়ে উঠেন। এইতো এখানেই ২০১৫ সালের ৯ মার্চ রীতিমতো ইতিহাস গড়েছিল লাল-সবুজের দল। এই মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নাম লেখায় বাংলাদেশ। 

ফের অ্যাডিলেডের মঞ্চ তৈরি। দেড়শ বছরেরও পুরোনো মাঠে আরও একবার বাংলাদেশ দল। ইংলিশ বধের সেই দলটার অনেক সদস্যই অবশ্য নেই। আছেন শুধু সাকিব আল হাসান আর তাসকিন আহমেদ। মেঘের আড়াল থেকে রোদ হেসে উঠেছে এখানে। বিশ্বকাপে দুটো জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পালেও সুবাতাস! এবার তাহলে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হৃদয়ে ফের লেখা হয়ে যাক নতুন কোন রোমাঞ্চের গল্প!

এটি/এনইউ