ফুটবল ‘ঈশ্বর’ খ্যাত ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনার সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। সময়ের হিসেবে ৯ ঘণ্টার ব্যবধান। আর্জেন্টিনায় যখন দুপুর আমাদের তখন রাত। আকাশপথেও দূরত্ব নেহাত কম নয়। কিন্তু আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনাকে নিয়ে যখন কোনো ঘটনা ঘটেছে, আমরা মুহূর্তের মধ্যে তা জানতে পেরেছি। শুধু তথ্য নয়, সঙ্গে সঙ্গে ফুটেজসহ আদ্যোপান্ত দেখতে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে দূরত্ব কোনো ব্যবধান হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনটা সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেট বা অনলাইন সাংবাদিকতার কল্যাণে। 

অতীতেও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের কিছু কিছু খবর দ্রুত পাওয়া যেত। কিন্তু তা নানান হাত ঘুরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছতে পৌঁছতে বয়ে যেত অনেকটা সময়। তাছাড়া তার পরিসর ছিল খুবই সীমিত। সাধারণের কাছে তা পৌঁছতে রাত পেরিয়ে যেত। মূলত পরের দিনের সংবাদপত্রই ছিল প্রধান নির্ভরতা।

আর এখন চোখের পলকেই যে কোনো তথ্য ও ফুটেজ পাওয়া যায়। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট লাইন সংযোগ থাকলে হাতের মুঠোয় চলে আসে পুরো দুনিয়া। পৃথিবীর যেখানে, যখনই কোনো ঘটনা ঘটুক না কেন, তা জানতে মোটেও বেগ পেতে হয় না। চট করেই জানা হয়ে যায়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটা হয়ে ওঠেছে মস্ত এক চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়া তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সঙ্গত কারণেই সংবাদপত্রের বাজার ক্রমশ সীমিত হয়ে পড়ছে। এমনকি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে সম্প্রচার মাধ্যমও। যে বা যাঁরা সংবাদপত্র পড়তে বা টেলিভিশন দেখতে অভ্যস্ত, তাঁরা হয়তো পুরানো অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না। প্রাকৃতিক নিয়মে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরানো ঘরানার এই মানুষদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। 

কিন্তু যারা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বেড়ে ওঠছেন, তাদের কাছে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের খুব একটা কদর নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সক্ষমতার কারণে নতুন এই প্রজন্ম নেট জেনারেশন হিসেবে পরিচিত। তাঁদের কাছে বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অনলাইন মিডিয়া। মোবাইলে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে দুনিয়ার তাবৎ বিষয়। অন্য কোনো মাধ্যমের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে না বললেই চলে। দিন দিন মোবাইল ফোন নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে এর প্রসার ও ব্যাপ্তি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশেরও বেশি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। এর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি। ইন্টারনেট ব্যবহার করেন প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মোবাইল ফোনে।

এখন আর কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। সবাই চায় চটজলদি ও তরতাজা খবর। তা পেতে হলে অনলাইন মিডিয়াই এখন প্রধান নির্ভরতা। অনলাইন মিডিয়ার কারণে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তথ্যপ্রবাহ। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ছে অপরিমেয় তথ্য। যার কোনো লাগাম নেই। নিয়ন্ত্রণহীন এই তথ্য ভাসিয়ে দিচ্ছে দুনিয়াকে। এখন তো একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠেছেন একটা মিডিয়া হাউস। একটা স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যে কেউ সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারেন। আর এটা সুলভ করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রবর্তন ঘটেছে সিটিজেন জার্নালিজমের। সংবাদমাধ্যমের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। প্রযুক্তিতে যে যতটা এগিয়ে সে ততটাই অগ্রসর। এখন সংবাদমাধ্যমের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠেছে অনেকটা কচু পাতায় টলমলে পানির মতো। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

তথ্য প্রবাহের এই নতুন যুগে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিকরা। এখন কোথাও কোনো খেলা হলে কিংবা ক্রীড়া সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটলে নিমিষেই তা নেটিজেনরা জানতে পারেন। নানান রকম ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। এমনকি তথ্য ও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে ড্রোন ক্যামেরার সাহায্যে। অনলাইন সাংবাদিকতার দিগন্ত অনেক বেশি উন্মোচিত ও প্রসারিত হয়েছে। পরিসর নিয়েও খুব বেশি চিন্তাভাবনা করতে হয় না। নানান আঙ্গিকে তথ্য পরিবেশন করা যায়। টেক্সট, ডেটার পাশাপাশি সংযুক্ত করা হয়েছে অডিও, ভিডিও, ডিজিটাল ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন রকম উপকরণ। রেফারেন্স হিসেবে যুক্ত করা হয় হাইপারলিংক। ইন্টার অ্যাকটিভ প্রক্রিয়ায় পাঠক বা দর্শকের মতামত গ্রহণ এবং ওয়েবিনারের মাধ্যমে ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে নানান বিষয়ে আদান-প্রদান করা হয়। কোনো কিছু আর একতরফা নেই। অনলাইন সাংবাদিকতার সারকথা, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’। 

করোনাভাইরাস নতুন এক পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অনেক দিন মাঠে খেলা ছিল না। বলতে গেলে ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না। অথচ পালন করতে হয়েছে পেশাগত দায়িত্ব। আর এখন মাঠে খেলা হচ্ছে। কিন্তু দর্শকদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সঙ্গে ক্রীড়া সাংবাদিকদের মানিয়ে নিতে হচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখেই ব্যবহার করতে হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।   

একইসঙ্গে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেড়েছে বিভ্রান্তি। তথ্যের নামে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুজব, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য। এমনকি সাজানো ছবি ও ফুটেজ দিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে সেটা যাচাই করা কঠিন হয়ে যায়। 

সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা ও কলাকৌশল অর্জন একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। দ্রুততা, দক্ষতা ও নির্ভুলভাবে তথ্য পরিবেশন করাই যোগ্যতার মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই সঙ্গে থাকতে হয় সততা, যথার্থতা, বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা ও পাঠক বা দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা। অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সারাক্ষণই খোলা রাখতে হয় চোখ-কান। কোথায় কী ঘটছে, তার খোঁজখবর রাখতে হয়। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে তারকা খেলোয়াড়রা সংযুক্ত। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকলে এর মাধ্যমে অনেক সময় পাওয়া যায় ব্রেকিং নিউজ। 

সব মিলিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতা আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। এই চ্যালেঞ্জ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাফল্যের মাপকাঠি দক্ষতা, মেধা ও সৃজনশীলতা। সেই সঙ্গে আপ-টু-ডেট থাকা। দেশ-বিদেশের ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কে নখদর্পণে রাখার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ নানান বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তথ্য পরিবেশনের সময়ে আবেগহীন থাকলেও বুকের ভেতর আবেগটা সজীব রাখতে হয়। ভেতরে লালন করতে হয় সাহিত্যিক মনমানসিকতা। লেখা কিংবা বলার সময় তার প্রতিফলন ঘটাতে হয়। অনলাইন মিডিয়ার মহাসাগরে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নিজেকে স্মার্টফোনের মতো স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। তাছাড়া এখন পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অনলাইনে কোনো কিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে তা ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াব্যাপী। 

নিউজ ওয়েবসাইট, মোবাইল বা অনলাইন জার্নালিজমের বিদ্যমান ধারা যে আগামীতে অটুট থাকবে, সেটাও কিন্তু হলফ করে বলা যায় না। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তি। তার সঙ্গে তাল মেলানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। মানিয়ে নিতে হচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন স্টাডিজ অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিকোলাস ডিয়াকোপুলোস বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে নিউজ রুমগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও এ সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। সামনে সাংবাদিকতার কাজের ধরনে পরিবর্তন আসবে। এমন ধরনের কাজ দেখা যাবে, যেখানে প্রথাগত রিপোর্টিংয়ের পরিমাণ কমে আসবে এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন বেশি হবে।’ এরই মধ্যে ধীরে ধীরে হলেও কোথাও কোথাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা হচ্ছে। তেমনটা হলে ক্রীড়া সাংবাদিকতা তথা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। 

শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়, আগামীতে প্রযুক্তি আরও কী ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে, আমরা তা অনুমান করতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইটা মোটেও সহজ হবে না। তবে সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াই হবে লড়াই করার প্রধান হাতিয়ার। অতীতেও যাঁরা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি, তাঁদেরকে সরে যেতে হয়েছে। আর আগামীতে আরও বড় পরিবর্তনের সঙ্গে উপযোজন করে নিতে হবে। তবে এটাও ঠিক, প্রযুক্তি যতই ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন, তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষ। মেধাবী মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অন্তত তার নেই। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

দুলাল মাহমুদ : সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত