সাক্ষাৎকারে নিগার সুলতানা জ্যোতি
পরের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে নিয়ে যেতে চাই
>> বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলা জ্যোতি এখন বিশ্বমঞ্চের নেতা
>> ‘পাকিস্তানের মাটিতে জাতীয় সংগীত গাওয়া, জীবনের বড় পাওয়া’
>> ছোটবেলায় চকলেটের লোভ দেখিয়ে ইংরেজি শেখাতেন বাবা
প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে ইতিহাস গড়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে, বেশ কয়েকটি ম্যাচে দারুণ লড়াই করেছে ম্যাচের শেষ অবধি। ব্যাট হাতে উজ্জ্বল না হলেও নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বের বেশ বড় ভূমিকা ছিল এমন লড়াইয়ের পেছনে।
নিজের পারফরম্যান্সকে অবশ্য কাঠগড়ায় তুলেছেন নিজেই। তার মতে, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় কাটিয়ে এসেছেন বিশ্বকাপে। তবে টাইগ্রেস অধিনায়ক স্বপ্ন দেখিয়েছেন বাংলাদেশকে পরের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলানোর।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে শুনিয়েছেন ফারজানা হকের সঙ্গে ২৩৬ রানের অবিশ্বাস্য সেই জুটির গল্প। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সর্বত্র। ছোটবেলায় লোভ দেখিয়ে বাবার শব্দার্থ শেখানো; এতে ভূমিকা রেখেছে যথার্থ।
পাকিস্তানের মাটিতে জাতীয় সংগীত গাইতে পারার সেই সুখস্মৃতি আজও তাকে আন্দোলিত করে। বলেন, ‘ওই সময় মনে হয়েছিল জীবনে বোধ হয় কিছু একটা করতে পেরেছি।’ কীভাবে ক্রিকেটার হলেন, হুট করে ম্যাচের তিন দিন আগে প্রথম উইকেট কিপার বনে গেলেন, বাংলাদেশের ব্যাটাররা কেন পারেন না— এমন নানা বিষয়ে কথা বলেছেন জ্যোতি। বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়কের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।
আপনাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল যেটা, সেটা দিয়েই শুরু করি। এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলেন?
জ্যোতি: আসলেই কৌতূহল আছে নাকি? জানতাম না তো! যেহেতু বললেন, এখন থেকে দেখতে হবে। যা-ই হোক, এটা আসলে হয়েছে আমার বাবার জন্য। যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন উনি আমাকে চকলেটের লোভ দেখাতেন। ওয়ার্ড মিনিংয়ের বই পাওয়া যায় না, ছোটবেলায় ছোট ছোট চকলেটের লোভ দেখিয়ে প্রতিদিন ওই বইগুলোর দুই পাতা করে মুখস্থ করাতেন বাবা। এজন্য অনেক বেশি শব্দ জানা।
ছোটবেলায় পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিলাম, বিশেষ করে ইংরেজিতে। গ্রামার বা যেকোনো কিছু…। এইচএসসি পরীক্ষায় তিন ঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টায় পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। তো, আমি খাতা জমা দিতে গেছি, শিক্ষকরা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি পার নাই, নাকি সত্যিই শেষ! আমি বলি শেষ। কিন্তু উনারা তো বিশ্বাসই করেন না!
আমি যখন হল থেকে বের হই, আমার আব্বু-আম্মুসহ সব অভিভাবক মনে করেছিলেন, আমি বোধ হয় নকল করেছি। এজন্য আমাকে বহিষ্কার করে বের করে দিয়েছে। তা না হলে এত তাড়াতাড়ি তো বের হওয়ার কথা নয়! আব্বু আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি লিখছ, নাকি লিখ নাই। কেউ-ই আমার কথা বিশ্বাস করে না।
বিষয়টা এরকমই। ছোটবেলা থেকে আমার ইংরেজির প্রতি অন্যরকম একটা ভালো লাগা ছিল। এছাড়া আমি প্রচুর ইংলিশ মুভি দেখতাম। এগুলো আমাকে ফ্লুয়েন্ট হতে সাহায্য করেছে।
ইংরেজিতে এত ভালো, পরে ধারাভাষ্যে আসবেন?
জ্যোতি: ভালো একটা বিষয় মাথায় ঢুকালেন তো! তবে এখন অবধি ওই ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই। যদিও বলা যায় না কখন কী হয়ে যায়! তবে ক্রিকেটের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা আছে।
বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে আসি। অনেক বড় একটা টুর্নামেন্ট খেলে আসলেন। কেমন কাটল?
জ্যোতি: ভালো-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে। ব্যক্তিগত কিছু অর্জন ছিল। কয়েকজন খেলোয়াড় ভালো করেছেন। তবে, দল হিসেবে আরেকটু ভালো করতে পারতাম। সেটা করতে পারলে আরও ভালো লাগত।
নিজের পারফরম্যান্স তো ভালো হলো না, নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট নন?
জ্যোতি: অবশ্যই ভালো হয়নি। সন্তুষ্ট হওয়ার জায়গা তো নেই-ই। আমার মনে হয়, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টা বোধ হয় কাটিয়েছি ওই কয়েকটা ম্যাচে। দলের জন্য যে ভূমিকাটা রাখার দরকার ছিল, বিশেষ করে টপ অর্ডারে ধারাবাহিকভাবে রান করা; সেটা একদমই করতে পারিনি।
আপনি যেমন বললেন, রান করতে পারেনি টপ অর্ডার, এটা তো দলকেও ভুগিয়েছে পুরো টুর্নামেন্টে...
জ্যোতি: আমি আসলে সবসময় নিজের ওপর দোষ নিতে পছন্দ করি। কারণ, আমি অন্যের ওপর বিশ্বাসী নই। সে ওটা করতে পারে নাই, তাই এটা হয় নাই— আমি এমনভাবে চিন্তা করি না। সবসময় মনে করি, আমি রান করতে পারি নাই, তাই দল ভুগেছে।
আমি রান করতে পারলে হয়তো আরও ভালো শুরু পেত, বোর্ডে আরও বেশি রান যোগ হতো। আমরা আরেকটু লড়াই করতে পারতাম। যে ম্যাচগুলোতে কাছাকাছি গেছি, দু-একটা জিততে পারতাম। এজন্য মনে হয় আমার পারফরম্যান্সের জন্য দলকে অনেক ভুগতে হয়েছে।
কিন্তু গত দুই বছর ধরে বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে আপনিই বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার। ২৪-এর উপরে গড়ে ৬০৪ রান করেছেন। ফরম্যাট বদলে যাওয়াতে সমস্যা হলো কি-না?
জ্যোতি: আসলে অজুহাত দিয়ে তো লাভ নেই। ফরম্যাট পরিবর্তন বা এমন কিছু নয়। অনেকগুলো ম্যাচে শুরুটা ভালো হয়েছে কিন্তু লম্বা করতে পারিনি। অনেকগুলো আবার শুরুই করতে পারিনি। অনেক সমস্যা হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে বাজে পারফর্ম করেছি। ফিরে আসতে পারিনি, যদি পারতাম তাহলে এটা হয়তো দলকে সাহায্য করতো।
আপনি বললেন, শুরু করেও লম্বা করতে পারেননি। আপনার কিন্তু লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্য আছে। টি-টোয়েন্টিতে তো সেঞ্চুরি করেছেন। ওয়ানডেতে অবশ্য এখনও পারেননি...
জ্যোতি: আসলে আমরা ওয়ানডে খেলেছি কম। বিশ্বকাপের আগে আমি সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছি ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর বাছাই পর্বের দুই ম্যাচ। সবমিলিয়ে ওয়ানডে খুব কম খেলা হয়েছে।
অনুশীলন আপনি যতই করেন না কেন, আন্তর্জাতিক ম্যাচ প্রচুর খেলতে হবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পারফর্ম করতে হলে চাপের মধ্যে খেলে শিখতে হবে। যত খেলব, পুরো দল হিসেবে ততই শিখতে পারব। অনুশীলন করে সেরা খেলোয়াড়রাই তো জাতীয় দলে খেলে।
ঘরোয়া ক্রিকেটের বোলার, আমাদের ধরেন মুখস্থ হয়ে গেছে…। আমরা জানি সে কখন, কোথায়, কী করবে? এখন আমাদের খেলতে হবে আন্তর্জাতিক দলগুলোর বিপক্ষে। আমার কাছে মনে হয় যত ম্যাচ খেলব, ততই আমাদের স্কিল বাড়বে।
এটা আসলেই একটা বড় বিষয়। বাংলাদেশ এতদিন একটা স্টেজে ছিল। এখন আরেকটা স্টেজে গেল। পার্থক্যটা আসলে কী দেখলেন… দুই জায়গায়?
জ্যোতি: পার্থক্যটা ম্যাচ কম খেলার, যেটা বারবার বলেছি। এছাড়া কিছু নয়। কারণ, এখন যদি আপনি আমাকে ঘরোয়া ক্রিকেটে নামিয়ে দেন, আমি হয়তো অনুশীলন বা কিছুই করিনি, সামহাউ যেভাবেই হোক হয়তো রান করে ফেলব। আমি এখানকার বোলার, প্রতিপক্ষ, কন্ডিশন— সবকিছু জানি। অনেক জ্ঞান আছে আমার এসব নিয়ে।
আপনি যদি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমাকে এখন নামান, প্রথম ম্যাচ থেকেই হয়তো ভালো হবে। কারণ, একটু হলেও ওদের সম্পর্কে আমরা জানি। তৃতীয়বার যখন নামব, তখন আরও ভালো করব। এভাবেই কিন্তু একটা দলের উন্নতি হয়। যত জানবেন, যত খেলবেন, তত বেশি আত্মবিশ্বাস আপনার ভেতরে তৈরি হবে।
বিশ্বকাপের একটা প্রসঙ্গ বলি। আপনার কাছে জানতে চাওয়া হলো- খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা আগে নাকি ম্যাচ জেতা? আপনি বললেন, নিরাপত্তা। সবসময়ই কি এমন স্পষ্টবাদী?
জ্যোতি: আমি সবসময়ই এমন। যে কথা আমার মনে হয় সত্যি, অনুভব করি এটা ঠিক…; সঠিক জায়গায় কথা বলতে ভয় পাই না, পিছপা হই না। যেটা আমার কাছে সত্যি মনে হয়, আমি সেটা বলে ফেলি, সেটা যেখানেই হোক না কেন।
এবার আপনার প্রসঙ্গে আসি। ক্রিকেটে কীভাবে এলেন?
জ্যোতি: ক্রিকেট আসলে শুরু করেছি মাত্র দুই বছর বয়সে। ভাইয়াদের সঙ্গে বাড়ির উঠানে খেলতাম তখন। ওখান থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। যখন বুঝতে শিখি, তখন ক্রিকেটের পরিবেশেই বড় হয়েছি।
যখন আরও একটু বড় হলাম, ভাইয়ারা টেপ টেনিস টুর্নামেন্ট খেলতে যেত বিভিন্ন জায়গায়। আমাকেও নিয়ে যেত, ওখানে টুকটাক খেলতাম। একটা সময় আসে যখন পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হই। চাপ বাড়তে থাকে, মাঝে খেলা বন্ধ করে দিই। সপ্তম শ্রেণি থেকে ফের শুরু করি।
২০১১ সালে ঢাকা লিগে এসে পেশাদার ক্রিকেট শুরু করি। বাংলাদেশে তো মেয়েদের ক্রিকেট শুরু হয় ২০০৭ সালে, আমি আসি ২০১১-তে। টুকটুক করে খেলতে খেলতে দুই বছর কাটিয়ে দেই শেখ জামালে। ২০১৩-তে রাইজিং গার্লস ক্রিকেট ক্লাবে, ওখানে একটু উপরের দিকে ব্যাট করা শুরু করি। আস্তে আস্তে ওপেনিং, ভালোই রান পাই।
এরপর ডাক পাই জাতীয় দলে। দুই বছরে ছয়/সাতটা ক্যাম্প করি। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিই।
অভিষেকে কি নার্ভাস ছিলেন নাকি রোমাঞ্চিত?
জ্যোতি: পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেললে আলাদা একটা রোমাঞ্চ থাকে সবার মধ্যে। ৭১-এ আমরা যুদ্ধ করে জিতেছি তাদের বিপক্ষে। সবার মনে থাকে কি-না জানি না, তবে আমার থাকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেললে আলাদা কিছু কাজ করে মনে।
পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া— এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত আর কী হতে পারে! তখন মনে হয়েছিল, জীবনে হয়তো কিছু একটা করতে পেরেছি।
যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজ দেশ পেয়েছি, তাদের মাটিতে গিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে পারা, পতাকা উড়ানো… এর চেয়ে আনন্দের আসলে কোনো কিছুতে নাই। সবমিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারাটা অনেক বেশি গর্বের। একটু নার্ভাস ছিলাম, কিন্তু দু-এক ওভারের পর সেটা কেটে যায়।
আপনি একটা লম্বা জার্নির কথা বললেন। এ যাত্রার কোথাও গিয়ে মনে হয়নি যে থেমে যাই বা ক্রিকেটটা আমাকে দিয়ে হচ্ছে না…
জ্যোতি: এখন পর্যন্ত আসলে তেমন মনে হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে আমার শুরু, কখনও টানা সূচি ছিল না। দেখা গেছে একটা টুর্নামেন্ট হয়েছে, দু-তিন মাসের বিরতি, আবার হয়েছে। পরে ছয়-সাত মাস কোনো খেলা নাই, ট্যুর নাই। আবার ট্যুর এসেছে, আবার ক্যাম্প… আবার নাই।
গত বছর থেকে আমরা টানা ক্রিকেটে আছি। কখনও ক্লান্ত হইনি, সবসময় আমরা খেলতে চেয়েছি।
খেলা বেশি থাকলে হয়তো থেমে যাওয়া বা ছেড়ে দেওয়ার বিষয় আসত। আসলে বেশি বেশি ম্যাচ হলে এবং সেখানে কিছু করতে না পারলে বা সফল না হলে নেতিবাচক বিষয়গুলো আসত। এমন পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত আসেনি বা কখনও ফিল হয়নি।
ক্রিকেটে আসার সময় কাউকে দেখে মনে হয়েছে যে তার মতো হতে চান?
জ্যোতি: সালমা আপুকে দেখে আমার ক্রিকেট খেলা শুরু। ২০০৭-এর পর তো উনিই অধিনায়ক ছিলেন জাতীয় দলের, অনেক ভালো ক্রিকেটারও। আমার ভাইয়া সবসময় উনার কথা বলতেন। উনার নামডাক বেশি ছিল, উনাকে বেশি দেখাতেন।
এখন সালমার অধিনায়ক আপনি। আইডলের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ারের অভিজ্ঞতাটা কেমন?
জ্যোতি: সালমা আপু এমন একটা চরিত্র…, দলের জন্য যিনি ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে পছন্দ করেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেন। অনেক অনেক বেশি দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ব্যক্তি হিসেবে, জুনিয়র-সিনিয়র সবাইকে সাহায্য করতে পছন্দ করেন।
কোনো বোলারের প্রবলেম হচ্ছে মাঠে, উনি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন। যতটুকু সম্ভব হৃদয় দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। উনি যেহেতু লম্বা সময় অধিনায়ক ছিলেন, আমার জন্য অনেক হেল্পফুল হয় এটা। কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দ্বিধায় থাকলে উনার সঙ্গে গিয়ে কথা বলি।
আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি অনেক ভাগ্যবান। যাকে দেখে ক্রিকেট খেলা শুরু, যাকে আদর্শ মনে করি; তার সঙ্গেই এখন খেলছি। একসময় আমি উনার অধীনে খেলেছি, এখন উনি আমার অধীনে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।
সালমাকে দেখে ক্রিকেট শুরু করলেন, এখন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের অধিনায়ক আপনি। ভাবলে কেমন লাগে?
জ্যোতি: মাঝেমধ্যে মনে হয় এগুলো সত্যি কি-না, নাকি স্বপ্ন। আবার চিন্তা করি, একটা সময় তাদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে চেয়েছিলাম, এখন পারছি। আমার কাছে মনে হয়, দলে আমিসহ জুনিয়র যারা আছি, তারা খুবই ভাগ্যবান।
কারণ, আমাদের সিনিয়র আপু, যারা ক্রিকেটটা শুরু করেছিলেন, এখনও তারা আছেন। তাদের পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তারা আমাদের গাইড করছেন। এ জায়গা থেকে আমরা খুবই ভাগ্যবান।
অধিনায়ক হিসেবে সিনিয়র-জুনিয়রদের ম্যানেজ করাও নিশ্চয়ই জটিল কাজ?
জ্যোতি: আমার কাছে আসলে জটিল মনে হয় না। কোনো কাজ আপনি আগেই যদি জটিল করে রাখেন, তাহলে সেটা জটিল। আমি এটাকে খুব উপভোগ করি। কারণ, অনেক আগে থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি অধিনায়কত্ব করে এসেছি।
ক্রিকেট বোর্ডও আমাকে সহায়তা করেছে। তাদের হয়তো পরিকল্পনা ছিল আমাকে অধিনায়কত্ব দেবে। এজন্য তারা আমাকে তৈরি করেছে, এরপর এত বড় দায়িত্ব দিয়েছে। ইমার্জিং বা অনুশীলন ম্যাচগুলোতে আমি অধিনায়কত্ব করেছি। ইমার্জিংয়ে দুই-তিনটা সিরিজ করে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পেয়েছি।
হয়তো ভালোভাবে তৈরি ছিলাম না, আবার ছিলামও। তবে এত দ্রুত পেয়ে যাব, ভাবিনি। কারণ, সাবেক কয়েকজন অধিনায়ক এখনও দলে আছেন। আরও দু-এক বছর পর পাব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু পেয়ে গেছি।
অনেক সময় কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে তো যেতেই হয়। মাঠের বাইরে কিছু না, কিন্তু মাঠের কঠিন জিনিসটাও সহজ করে দিয়েছেন সিনিয়ররা। কারণ, তারা নিজেদের কাজটা জানেন।
অধিনায়ক হিসেবে দলকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?
জ্যোতি: আমরা যেহেতু আইসিসির ক্যালেন্ডারে ঢুকে গেছি, অনেক ম্যাচ খেলতে হবে। ঘরে ও ঘরের বাইরে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে হবে। আমি বলব, দলের জন্য এটা অনেক বড় সুযোগ; বিশেষ করে দল হিসেবে পারফর্ম করার। যেহেতু কখনও এত ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি, এটাই প্রথম; ফলে যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে সেরা খেলাটা দিতে হবে আমাদের।
দল হিসেবে এবং ব্যক্তিগতভাবে পারফর্ম করার এটাই সেরা সময়। পরের বিশ্বকাপের আগে এখনও তিন-সাড়ে তিন বছর সময় আছে। আমরা দলকে এমন একটা জায়গায় নিতে চাই, আগামী বিশ্বকাপে যেন আমরা সেমিফাইনালে খেলতে পারি।
এবারের বিশ্বকাপে অন্য দলগুলোতে অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিলেন, কারও সঙ্গে কথা হয়েছে কি?
জ্যোতি: জৈব সুরক্ষা বলয়ের জন্য এটা আসলে হয়নি। কারণ, সবাই আলাদা ফ্লোর বা হোটেলে ছিলাম। এক ফ্লোর থেকে আরেক ফ্লোরে যাওয়াও নিষেধ ছিল। মাঠের ভেতরে টুকটাক কথা হয়েছে। তাও খুব কম। টসের সময় হয়তো অধিনায়কের সঙ্গে কথা হয়েছে। অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির সুযোগ তেমন হয়নি।
ইচ্ছা তো ছিল?
জ্যোতি: ইচ্ছা বলতে, বিসমাহর সঙ্গে তো খেলি, কথা হয়। মিতালি রাজের সঙ্গে টসের সময় টুকটাক কথা হয়েছে। আর যদি ইচ্ছার কথা বলেন, মেগ ল্যানিং সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। ও অনেক অভিজ্ঞ, বিশ্বের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। ওর কাছে জানার ইচ্ছা ছিল কীভাবে সে ক্রিকেটটা দেখে বা লাইফটা লিড করে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো লাগত।
আপনার খেলায় ফিরে আসি। ব্যাটিং নাকি উইকেট কিপিং— কোনটা বেশি কঠিন লাগে?
জ্যোতি: আসলে কোনোটাই কঠিন নয়। যখন আপনি কিছু করতে পারবেন না তখনই কঠিন মনে হবে। ব্যাটিংয়ে গিয়ে রান করতে না পারলে কঠিন তো লাগবেই! আমার কাছে কখনও কঠিন মনে হয়নি, আসলে খারাপ দিন গেছে। ভালোবেসে তো ক্রিকেটটা খেলি, খারাপ বা ভালো দিন যাবেই; কখনও কঠিন মনে হয়নি।
তবে, যখন ব্যাট ধরতে জানতাম না, কীভাবে কী করতে হয়, কোন বলে কোন শট খেলতে হয়; তখন কঠিন মনে হতো। এখন তো সব জানি, কঠিন আর মনে হয় না।
উইকেটরক্ষক কি হুট করেই হয়ে গেলেন, নাকি ইচ্ছা করেই শুরু করলেন?
জ্যোতি: শুরুর দিকে ব্যাটিংই করতাম। আমি আসলে মুশফিক ভাইকে অনেক ফলো করতাম। ভাবতাম, উনি পুরুষ দলের উইকেটরক্ষক, আমি নারী দলের হব। মজার বিষয় হচ্ছে, আমার যখন ১২ বছর বয়স, তখন জেলাভিত্তিক প্রথম ম্যাচে আমাদের দলে উইকেটরক্ষকই ছিল না।
তখন আমার কোচ বললেন, তুই তো ভালো ফিল্ডিং করিস, তুই-ই উইকেটকিপিং কর। আমি বললাম, স্যার আমি তো কখনও করি নাই। উনি বললেন, তুই পারবি; এটা বলে গ্লাভস ধরিয়ে দিলেন। ওই প্রথম উইকেটকিপিং করা।
আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে কিন্তু ফারজানার সঙ্গে করা ২৩৬ রানের জুটির বিষয়ে জানতে চাইব না— এটা তো হয় না। ওই গল্পটা যদি বলতেন…
জ্যোতি: ওই ম্যাচটা যে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে ধরা হবে, সেটাই আসলে জানতাম না। ব্যাপারটা হলো এমন, আমরা আগের সবগুলো ম্যাচে পরে ব্যাটিং করেছি। তখন ফাইনাল নিশ্চিত। এরপর চিন্তা করলাম, ফাইনালে যদি আগে ব্যাট করতে হয়…, এই ভেবে ব্যাটিং নিলাম।
ভাবলাম, তাদের বোলিং তো খুব বেশি ভালো না। আমি যেহেতু মিডল-অর্ডার, হয়তো ব্যাটিংটা পাব না। টপ অর্ডাররা শেষ করে দেবে। কিন্তু দুই উইকেট পড়ে গেল, আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল রানটা একটু ভালো পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। পরে মনে হলো, খেলছি যখন খেলতে থাকি!
একটা সময় দেখা গেল রান ৯০-এর মতো হয়ে গেছে। এরপর ভাবলাম সেঞ্চুরিটা করে উঠে যাই। কিন্তু পিংকি আপু ব্যাট করা শুরু করেছে, আমি আর স্ট্রাইকই পাই না। উনিও সেঞ্চুরির কাছাকাছি চলে এসেছেন। এরপর আমি ১০০ রান করলাম।
আমাকে বলা হলো পিংকিকে দিয়েও সেঞ্চুরিটা করা। তাহলে এটা ব্যক্তিগত রেকর্ড হয়ে থাকবে। আসলে পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে খেলতেই ওই পর্যায়ে যাওয়া। কিন্তু এটা যে রেকর্ড হবে, আমরা সেটা জানতাম না। মাঠের বাইরে যাওয়ার পর জানলাম, রেকর্ড হয়েছে। তখন অনেক এক্সাইটেড লাগছিল; ওহ আচ্ছা, কিছু একটা তাহলে করলাম!
এটা একদম অজান্তেই হয়েছে। আমাদের মোমেন্টাম ছিল খেলার। বল পাচ্ছিলাম, মারার বল মারছিলাম। আমি শুধু পিংকি আপুকে বলেছি, যতক্ষণ সম্ভব হয় খেলতে থাক। তুলে নিলে তো নিলোই। যতক্ষণ আছ আক্রমণাত্মক খেলে যাও। এ ম্যাচে বড় রান হলে পরের ম্যাচে বাড়তি আত্মবিশ্বাস পাব।
ওই ম্যাচটা ভালো হলেও ব্যাটিং কিন্তু সবসময়ই বাংলাদেশের চিন্তার জায়গা। এটা কেন মনে হয় আপনার?
জ্যোতি: বোলাররা কিন্তু একটা ম্যাচে অনেকবার ফিরে আসার সুযোগ পান। ব্যাটসম্যানরা এটা পান না। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের বোলাররা সবসময়ই ভালো করেন। কিন্তু ব্যাটিং যেদিন ভালো হয় সেদিন আমরা ম্যাচ জিতি। নয়তো জিততে পারি না।
হয়তো দু-একজন আলাদাভাবে পারফর্ম করেন। কিন্তু যেটা প্রয়োজন, অন্তত দুজন ব্যাটারের বড় ইনিংস খেলা, বাকিরা তাদের সমর্থন দেবে। আমাদের সেটা হয় না। একজন বা দুজন খেলছে, বাকিরা খেলতে পারে না। আমার মনে হয়, আরও বেশি ম্যাচ খেললে এ সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে। মানসিকভাবে আমরা আরও বেশি শক্তিশালী হব। তখন রান করাও সহজ হবে।
বলা হয়, শারীরিকভাবে আমরা পিছিয়ে। গায়ের জোরের ব্যাপার— এমন কি?
জ্যোতি: ইউরোপের মতো জন্মগতভাবে আমরা শক্তিশালী না। আমাদের শক্তিশালী হতে হয়। পরিশ্রম করে আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হয়। আর জন্মগতভাবে মেয়েদের শক্তি এমনিতেই কম। এখানে আমাদের উন্নতি করতে হয়।
এটা নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডও কাজ করছে। ফিটনেস বা শারিরীক শক্তি কীভাবে উন্নতি হয়, এটার জন্য অফ সিজন লাগে। ম্যাচের সময় আপনি ম্যাচের জন্য অনুশীলন করবেন নাকি এসব নিয়ে কাজ করবেন? এজন্য অফ সিজন প্রয়োজন। এগুলো নিয়ে আমার মনে হয় বিসিবি পরিকল্পনা করে রেখেছে। কারণ, ক্রিকেটে ফিটনেসটা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আপনার নিজের কোনো পরামর্শ আছে কি?
জ্যোতি: ক্রিকেট বোর্ড ভালোভাবেই জানে কী কী করতে হবে। অবশ্যই আমার কাছে যদি কখনও জিজ্ঞাসা করে, এমনিতেও তাদের সঙ্গে কথা হয়, তখন শেয়ার করি। ফিটনেস বলেন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচের কথা বলেন, আমার কাছে মনে হয় যত ম্যাচ খেলব, ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে তত উন্নতি করব।
সাত বছর ক্রিকেট খেলেছেন, মেয়েদের ক্রিকেটটা আসলে কোথায় আছে বাংলাদেশে?
জ্যোতি: হ্যাঁ, লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচ কম খেলেছি। তবুও যেহেতু অনেক লম্বা সময় ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে আছি, ওই অভিজ্ঞতা থেকে বলব, আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। সালমা আপুরা যখন শুরু করেন, তখন মানুষ এটা ভালোভাবে নিত না।
এখন মনে হয় অনেকটা সহজভাবে নিচ্ছেন। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের পর এটা অনেক স্পষ্ট হয়েছে। মেয়েদের ক্রিকেটে অনেক উন্নতি হচ্ছে। অনূর্ধ্ব পর্যায়ের দল হচ্ছে, প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগ খেলা হচ্ছে, অনেক মেয়ে আসছে। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে মেয়েদের ক্রিকেট অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এটা দিন দিন আরও বাড়বে। গ্রাফটা আর নিচে নামবে না।
ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
জ্যোতি: সবারই নিজের একটা লক্ষ্য থাকে, সেরা ১০-এর মধ্যে জায়গা করে নেওয়া। যখন ওখানে যেতে পারব, তখনই স্বপ্ন পূরণ হবে। এজন্য দলের হয়ে সেরা খেলাটাই খেলে যেতে চাই।
আপনাকে ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইল...
জ্যোতি: আপনাকেও ধন্যবাদ। আমার এবং আমাদের দলের জন্য দোয়া করবেন...