বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলছে আজ (রোববার)। এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশবাসী। ক্রীড়াঙ্গনের ব্যক্তিরাও তাকিয়ে থাকবেন বিশেষ কয়েকটি আসনের দিকে। সাবেক ও বর্তমান ক্রীড়াবিদরা কয়েকটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন। আবার ক্রীড়া সংগঠকরাও লড়ছেন অনেক আসনে।

যেসব আসনে ক্রীড়াঙ্গনের দৃষ্টি থাকবে—

মাগুরা-১ (সাকিব আল হাসান) : এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নিজ জেলা মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কের বিপক্ষে তেমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। অনেক জেলায় আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও সাকিবের আসনে তেমনটা নেই। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও সাকিবের পক্ষেই কাজ করছেন। 

নড়াইল-২ (মাশরাফি বিন মুতর্জা) : এই নির্বাচনের চমক যেমন সাকিব, তেমনি গত নির্বাচনের চমক ছিলেন সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মাশরাফি। এবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন এই তারকা ক্রিকেটার। মাশরাফির আসনেও তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস নেই।

মানিকগঞ্জ-২ (দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল) : ক্রীড়াঙ্গনে আওয়ামীপন্থি ক্রীড়াবিদ-সংগঠকদের আলোচনায় সবার আগে নাম আসে সাবেক তারকা ফুটবলার দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুলের। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এক যুগেরও বেশি সময়। ২০০১ সালে নিজ জেলা মানিকগঞ্জ-২ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে গত নির্বাচনগুলোতে মনোনয়ন পাননি। এবার দলের বাইরে স্বতন্ত্র নির্বাচনের সুযোগ থাকায় তিনি প্রার্থী হয়েছেন। মোড়া প্রতীক নিয়ে লড়ছেন টুটুল। এই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান এমপি মমতাজ বেগম এবং আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী তার চাচাতো ভাই দেওয়ান জাহিদ আহমেদ (টুলু)।

নেত্রকোনা-২ (আরিফ খান জয়) : ক্রীড়াবিদ থেকে ক্রীড়ামন্ত্রী হওয়ার একমাত্র কৃতিত্ব সাবেক জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক আরিফ খান জয়ের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নেত্রকোনা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। পরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী হন। এর পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনি প্রার্থীতা করেননি। এবারও দলীয় মনোনয়ন পাননি জয়। এরপরও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। গত কয়েক বছর তৃণমূলে কাজ করার সুবাদে এবার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী সাবেক এই ফুটবলার।

বাঁ থেকে দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল, আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ও আরিফ খান জয়

খুলনা-৪ (আব্দুস সালাম মুর্শেদী) : সাবেক তারকা ফুটবলার আব্দুস সালাম মুর্শেদী খুলনা-৪ আসনে দুই বারের সংসদ সদস্য। তৃতীয় বারের মতো তিনি এই আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। আব্দুস সালাম মুর্শেদীর মূল প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী মোর্তজা রশিদী দারা। তিনিও ক্রীড়াঙ্গনের লোক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক, খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সদস্য। খুলনা জেলার রাজনীতির সঙ্গে তাদের পরিবার অনেক আগে থেকেই সম্পৃক্ত। তার বড় ভাই এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। দারার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরই মূলত সালাম মুর্শেদী এই আসনের সংসদ সদস্য হন। এই আসনটি মূলত ক্রীড়াঙ্গনের লড়াই। 

নোয়াখালী-২ (আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক) : বাফুফের নতুন সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে সংগঠক হিসেবে পথচলা শুরু করেছেন সম্প্রতি। তবে বাফুফের সহ-সভাপতি হয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি থাকলেও রাজনীতির অঙ্গনেও পদচারণা ছিল তার। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন মানিক। তার প্রধান প্রতিপক্ষ বর্তমান সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোরশেদ আলম। নানা সূত্রের খবর, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া সকল প্রার্থীরা মানিককে সমর্থন দেওয়ায় তার জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। 

যশোর-৩ (কাজী নাবিল আহমেদ) : দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বাফুফের সহ-সভাপতি পদে নাবিল ১৫ বছর। ক্রীড়া সংগঠক থেকে রাজনীতি অঙ্গনেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নাবিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও নির্বাচিত হন তিনি। এবার তৃতীয় বারের মতো দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন নাবিল। ক্রীড়াঙ্গনের দৃষ্টি থাকবে এই আসনের দিকে। 

ঢাকা-১ (সালমান এফ রহমান) : দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সালমান এফ রহমান। ব্যবসায়ী ও রাজনীতি অঙ্গনে তার পরিচিতি বেশি হলেও ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে তার বিশাল ব্যাপ্তি। দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঢাকা আবাহনীর চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। তিন দশকের বেশি সময় তিনি ক্লাবটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। লিমিটেড হওয়ার আগে থেকেই ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। সালমান এফ রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। 

কিশোরগঞ্জ-৬ (নাজমুল হাসান পাপন) : রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান নাজমুল হাসান পাপন। তার বাবা প্রয়াত জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এবং বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তার মা প্রয়াত আইভি রহমানও আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মী ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। গত এক দশকে রাজনীতির চেয়ে ক্রীড়াঙ্গনেও বেশি পরিচিতি হয়েছে পাপনের। দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা বিসিবির সভাপতি পাপন। ২০১২ সাল থেকে বিসিবির সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন। বিসিবি ছাড়াও ঢাকা আবাহনীর অন্যতম পরিচালক তিনি। এই আসনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস নেই। এরপরও ক্রীড়াঙ্গনের চোখ থাকবে কত ভোটে জয়ী হলেন পাপন।

গাজীপুর-২ (জাহিদ আহসান রাসেল) : ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক নন, এরপরও গাজীপুর-২ আসনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকবে ক্রীড়াঙ্গনের। কারণ বর্তমান ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় জাহিদ আহসান রাসেল ওই আসনের প্রার্থী। তার বিপক্ষে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। তবে মূল প্রতিপক্ষ গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর। 

ঢাকা-৯ (সাবের হোসেন চৌধুরি): বাংলাদেশের ক্রিকেটের নব রূপকার সাবের হোসেন চৌধুরি। বিসিবির সাবেক এই সভাপতি টানা কয়েকবার ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য। নিজ আসনে পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই আসনে তেমন শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায়, খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হচ্ছে না সাবের হোসেন চৌধুরিকে। 

ঢাকা-৮ (বাহাউদ্দিন নাছিম) : বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিকেন্দ্রীকরণ তেমন হয়নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা প্রায় সবই ঢাকাকেন্দ্রীক। রাজধানী ঢাকার মতিঝিল ও পল্টন এলাকার মধ্যে অধিকাংশ ফেডারেশন ও ক্রীড়া স্থাপনা। ক্রীড়া অঞ্চলের সংসদ সদস্য কে নির্বাচিত হন এ নিয়ে কৌতুহল রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনে। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীই নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যায়নি। 

চট্টগ্রাম-১২ (সামছুল হক চৌধুরি) : বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। এদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের প্রভাবশালী এমপি সামছুল হক চৌধুরি এমপি। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। তিনি বাফুফের সাবেক সদস্য এবং প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের দল চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাসচিব। এই আসনে বাড়তি আগ্রহ ক্রীড়াঙ্গনের, কারণ এই আসনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন বাফুফের সদস্য ও সাবেক তারকা ফুটবলার সত্যজিত দাশ রুপু। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন না করে নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন।

বিভিন্ন ফেডারেশনের আরও যারা আছেন :

ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব ফেডারেশনের সভাপতি সরকার কর্তৃক মনোনীত। অনেক ফেডারেশনের সভাপতি বর্তমান এমপি, আবার মন্ত্রীও রয়েছেন। এদের অনেকেই পুনরায় দাঁড়িয়েছেন, আবার প্রথমবারের মতো নির্বাচন করছেন কেউ কেউ। রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ নিজ জেলা ময়মনসিংহ থেকে প্রার্থী হয়েছেন। টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরি পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাইক্লিং ফেডারেশনের সহ-সভাপতি সানজিদা খানম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ঢাকা-৪ আসন থেকে। ঢাকা আবাহনীর পরিচালক নসরুল হামিদ বিপু ও শাহরিয়ার আলমসহ আরও অনেকে নির্বাচন করছেন, যাদের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

এজেড/এএইচএস