মুসলিম নারীর প্রতীকী ছবি।

প্রিয়নবীর চার মেয়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠ হলেন ফাতিমা জাহরা (রা.)। তার মা খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.)। নবী বংশের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ফাতিমা। তার থেকেই নবীজির বংশধারা চলমান।

জন্ম ও অন্যান্য

তিনি নবীজির নবুওতপ্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। ওই বছরই কোরাইশ গোত্র কাবার পুননির্মাণ করেছিল। প্রিয়নবীর বয়স তখন ৩৫ বছর। আরেক বর্ণনামতে নবুওতপ্রাপ্তির এক বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তখন নবীজির বয়স ছিল ৪১ বছর।

বিয়ে-শাদি ও পরবর্তী জীবন

ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.)। তিনি নবীকন্যা ফাতিমা (রা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব করলে নবীজি সম্মত হন। আলী (রা.) নবীজির প্রতিউত্তর শুনে কৃতজ্ঞতার সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এখন যে তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নবীবংশে আত্মীয়তা করতে যাচ্ছেন। নবীজি তাদের জন্য বরকত এবং নেক সন্তানের দোয়া করেন। একটি আদর্শ ও অনুকরণীয় বিয়ে এটি। ফাতিমার বয়স ছিল তখন ১৫ বছর সাড়ে ৫ মাস। আর আলী (রা.)-এর বয়স ছিল ২১ বছর ৫ মাস।

বরকতময় এ বিয়েতে সাহাবিদের একটি দল উপস্থিত হন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.), ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.), ওসমান ইবনে আফফান (রা.), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) ও জোবায়ের (রা.) প্রমুখ মুহাজির ও কতিপয় আনসার সাহাবায়ে কেরাম তাদের অন্যতম। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবিয়্যাত, পৃষ্ঠা : ৩৭-৩৮)

সন্তান-সন্ততি ও পরবর্তী প্রজন্ম

তিনি বেশ কয়েকজন ভাগ্যবান সন্তানের জননী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। সন্তানরা সবাই ছিলেন আলী (রা.)-এর ঔরসজাত। পুত্র সন্তানরা হলেন- হাসান, হোসাইন ও মুহসিন। মেয়েরা হলেন- জয়নব ও উম্মে কুলসুম।

অনুপম চরিত্র-মাধুর্য

তিনি ছিলেন এমন কিছু বৈচিত্রময় গুণের অধিকারী নারী, যা তাকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। রাসুলের সঙ্গে তার অনেক মিল ছিল। বিনয়, স্থিরতা, গাম্ভীর্য, কথার মাধুর্য সবগুলো গুণ সমভাবে তার মধ্যে ছিল। ধৈর্য ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। জীবনের পরতে পরতে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা তিনি প্রদর্শন করেন। হিজরতের আগে ছোট বয়সেই মা খাদিজা ইন্তেকাল করেন। জীবদ্দশাতেই বোন রুকাইয়্যা, উম্মে কুলসুম তারপর জয়নবকে হারান।

জীবদ্দশায় তিনি বাবা মুহাম্মদকেও (সা.) হারান। ‘নবীজিকে দাফন করে এলে ফাতিমা (রা.) সাহাবি আনাসকে (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে তোমাদের জন্য সম্ভব হলো- আল্লাহর রাসুলের ওপর মাটি চাপা দিতে!’ (বুখারি, হাদিস : ৪৪৬২)

অল্পেতুষ্ঠি ছিল তার জীবনের অনুপম সৌন্দর্য। যদিও তিনি জানতেন যে, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল, শেষনবীর কন্যা। তারপরও বিলাসিতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দকর জীবনের প্রতি আকর্ষিত ছিলেন না। অল্প মোহরের বিয়েতে তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। তার বিয়ের মোহর ছিল মাত্র একটি বর্ম। বাবার পক্ষ থেকে বিয়ের উপঢৌকনও ছিল নিতান্তই সামান্য কিছু। একটি চৌকি, ভেতরে খেজুর পাতা ভরা চামড়ার একটি বালিশ এবং (পানি রাখার) একটি মশক বা থলে।

বিয়ের পর একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। নিজেই ঘরের কাজকর্ম সম্পাদন করতেন। আলী (রা.) বলেন, ফাতিমাকে বিয়ে করার সময় ঘুমানোর জন্য আমাদের একটি মাত্র বিছানা ছিল। আমার ও তার কোনো সেবক ছিল না। একবার নবীজির কাছে সেবক চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমরা যা চেয়েছে এর থেকে উত্তম কিছুর নির্দেশনা দেব না? যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করবে কিংবা বিছানার কাছে যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে। এটা তোমাদের জন্য সেবক থেকে উত্তম হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩৬১)

পিতা মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা

তিনি নবীজিকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। তার কষ্ট দূর করতেন। একবার নামাজরত অবস্থায় আবু জেহেল মহনবীর কাঁধে কিছু নাড়িভূঁড়ি রেখে দিয়েছিল। ফাতিমা সেটা দেখে তা সরানোর জন্য দৌঁড়ে গেলেন। বাবার কষ্টে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। তিনি সব সময় বাবাকে বলতেন, হে আব্বু, আমি আপনাকে সাহায্য করব। অথচ তখন তিনি ছিলেন অল্প বয়েসী কিশোরী। সেটা করতে তিনি সক্ষম হওয়ার কথা না। এটা তিনি করতেন মূলত বাবার কষ্ট লাঘব করার জন্য এবং তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। (মুকতাতিফাত মিনাস সিরাহ, পৃষ্ঠা : ১৪)

তিনি ছিলেন রাসুলের সর্বাধিক স্নেহের ও আদরের দুলালি। যখনই রাসুলের কাছে যেতেন রাসুল তাকে অভ্যর্থনা জানাতেন। মাথায় চুমো দিতেন। সম্মানার্থে পাশে বসাতেন। মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘ফাতিমা (রা.) আমার অংশ। যে তাকে রাগান্বিত করল, সে আমাকে রাগান্বিত করল।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৭১৪) তাই তো ফাতিমা যা অপছন্দ করতেন নবীজিও তা অপছন্দ করতেন।

নবীজি সফর কিংবা যুদ্ধ থেকে ফিরলে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তেন। এরপরই ফাতিমার এখানে গিয়ে তার খোঁজখবর নিতেন। তারপর যেতেন স্ত্রীদের কাছে। মৃত্যুর আগে ফাতিমা নবীজির কাছে গেলে নবীজি তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, অভ্যর্থনা জানান। পাশে বসিয়ে কানে কানে কথা বললে তিনি কেঁদে ফেলেন। আরেকবার একটি কানে কানে কথা বললে তিনি হেসে উঠেন। এটা এ কারণে ছিল যে, নবীজি প্রথমবার তাকে ইন্তেকালের সংবাদ দেন এবং দ্বিতীয়বার তিনিই সর্বপ্রথম তার সঙ্গে পরকালে মিলিত হবেন বলে সুসংবাদ প্রদান করেন।

নবীজি ইন্তেকালের পর তিনি মাত্র ৬ মাস জীবিত ছিলেন। নবীজির শোকে এ সময় তিনি অনেক ভেঙে পড়েন। পিতৃবিয়োগে এতই কাতর হয়ে পড়েন যে, মৃত্যু পর্র্যন্ত ৬ মাস তাকে হাসতে দেখা যায়নি।

ইসলাম তার সম্মান ও মর্যাদা

তিনি ইসলামে অনেক উঁচু মর্যাদা লাভ করেন। নবীজি তাকে পৃথিবীর সকল নারীদের শ্রেষ্ঠ গণ্য করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, জগতের সব নারী থেকে চারজন নারী অনুকরণের জন্য যথেষ্ট- মরিয়ম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৭৮)

আখিরাতেও নারীদের সরদার হবেন এ মহীয়সী নারী। নবী (সা.) বলেন, ‘ইনি একজন ফেরেশতা ভূপৃষ্ঠে এ রাতের আগে কখনও অবতরণ করেননি, তিনি স্বীয় প্রভুর কাছে অনুমতি চাইলেন যে, আমাকে সালাম দেবেন এবং আমাকে সুসংবাদ দেবেন যে, ফাতিমা জান্নাতের নারীদের সরদার এবং হাসান-হোসাইন জান্নাতের যুবকদের সরদার।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৮১) তিনি মোট ১৮টি হাদিস বর্ণনা করেন।

মৃত্যু ও পরকালের পথে যাত্রা

তিনি একাদশ হিজরির রমজান মাসের ৩ তারিখে মাত্র ২৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগের অসিয়ত অনুসারে আসমা বিনতে উমাইস (রা.) আলী (রা.)-এর সঙ্গে গোসল দেন। তারপর আলী (রা.) আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে (রা.) সঙ্গে করে জানাজার নামাজের ইমামতি করেন। অসিয়ত মোতাবেক রাতেই তাকে সমাহিত করা হয়।

নূর মুহাম্মদ রাহমানী।। শিক্ষক হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।