ড. আকরাম নদভী ও মুসলিম নারী স্কলারদের অবদান নিয়ে রচিত ৪৩ খণ্ডের গ্রন্থ।

জ্ঞান-অবিজ্ঞান ও হাদিসশাস্ত্রের নানা শাখায় প্রাচীন মুসলিম নারীদের অবদান নিয়ে ৪৩ খণ্ডে রচিত হয়েছে— ‘আল-ওয়াফা বিআসমায়িন নিসা’। এটি ইসলামী ইতিহাসে নারী স্কলার ও হাদিসবেত্তাদের জীবনীসংক্রান্ত সর্ববৃহৎ কাজ। দশ হাজারের অধিক নারী মুহাদ্দিস-শিক্ষাবিদদের জীবন, কর্ম ও অবদান এতে স্থান পেয়েছে।

বুধবার (১৩ জানুয়ারি) সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ বিখ্যাত প্রকাশনী দারুল মিনহাজ থেকে বিশাল কলেবরের গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এটি রচনা করেছেন প্রখ্যাত গবেষক ও হাদিসবিশারদ ড. আকরাম নদভী। দীর্ঘ ১৫ বছর বিভিন্ন দেশের পাণ্ডুলিপি গবেষণা করে অনবদ্য এই গ্রন্থটি তিনি রচনা করেন।

বিজ্ঞজনদের মতে, কোনো ভাষা ও বিষয়েও শুধু নারীদের অবদান নিয়ে এমন গবেষণামূলক বৃহৎ কাজ আর নেই। এর আগে ২০০৭ সালে ‘আল মুহাদ্দিসাত : দ্য ওম্যান স্কলারস ইন ইসলাম’ নামে গ্রন্থটির ভূমিকা সংস্করণ ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজির পিডিএফ পাওয়া যায়; বাংলায়ও অনুবাদ হয়েছে। তখন বিশ্বের গবেষণা পরিমণ্ডল ও উচ্চ পাঠকমহলে বেশ সাড়া জাগায় এটি।

একুশ শতকে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে বইটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ইতিহাসবিদদের জন্য একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবেও কাজে দেবে। এছাড়াও যারা প্রতিনিয়ত ইসলামকে নারীদের পশ্চাৎপদতার মিথ্যা অভিযোগ করেন এবং মুসলিমদের নারী-শিক্ষার বিরোধী হিসেবে হাজির করতে চান— তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরবে।

কালজয়ী গ্রন্থটির নেপথ্যে
বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ম্যাগাজিনে তিনি একবার একটা প্রবন্ধ পড়েন— যেটাতে মুসলিম নারীশিক্ষার ইতিহাসকে নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। সেটা পড়ে তিনি চিন্তা করেন এবং বিষয়টি নিয়ে একটা পুস্তিকা লেখার মন-স্থির করেন। কারণ, হাদিসের রাবীদের বর্ণনায় প্রচুর নারীদের নাম রয়েছে। আর মুসলিম নারীদের শিক্ষার ইতিহাস প্রবন্ধটির সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তাঁর ইচ্ছে প্রসঙ্গে সহকর্মী ও ইহুদি লেখিকা কার্লা পাওয়ারকে জানিয়ে বলেন, আমি একটা পুস্তিকা লিখছি, তুমি এতে আগ্রহী হবে। কিন্তু সেই পুস্তিকা লিখতে গিয়ে ড. আকরাম নদভী চলে যান গবেষণার গভীর অতলান্তিকে।

গবেষণা-এষণার স্মৃতি রোমন্থন
সেই কাহিনি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘হাদিস বর্ণনাকারী অনেক নারীদের জীবনী সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। আমি তাদের জীবনী সংকলন শুরু করি। ইসলাম নিয়ে বিখ্যাত পবিত্রকার মিথ্যাচার রোধে এক-দুই খণ্ডে তা শেষ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সৌদি, সিরিয়া, মরক্কো, ভারত ও তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে এ বিষয়ে অগণিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে জানতে পারি। তাই ভাবলাম এ বিষয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে কাজ করা জরুরি।’

আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম সমাজে শান্তির প্রসার’ শীর্ষক সম্মেলনে সৌদিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-ওয়াতানকে ড. নদভী বলেন, ‘গ্রন্থটিতে হাদিসের শ্রবণ, ইজাজাত, বর্ণনা ও রচনায় মহানবী মুহাম্মদ (সা.) থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত ‍মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।’

ইসলামের সোনালি যুগের মতো এ যুগের নারীরাও যেন শিক্ষা-গবেষণা ও অধ্যয়নে ব্রতী হন— সে উদ্দেশ্যেই মূলত গ্রন্থটি লেখা হয়েছে। এছাড়াও মুসলিম নারীরা নিপীড়িত ও নির্যাতিত বলে প্রাচ্যবিদদের যে অপপ্রচার রয়েছে, সেটার জবাব হিসেবে আড়ালে থাকা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এতে।

ড. নদভী আরো বলেন

সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য
ড. আকরাম নদভী ভারতীয় বংশোদ্ভুত সুপরিচিত আলেম। হাদিস-ফিকাহ বিষয় ও মুসলিম পণ্ডিতদের জীবনীসহ ৩০টিরও বেশি বইয়ের লেখক। ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন এবং আল-সালাম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ও মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো। এছাড়াও তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো (১৯৮৯-২০১৩) ছিলেন।

জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের জৈনপুরে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৮২ হিজরিতে। বাবার নাম হাফিজ তাজাম্মুল হুসাইন বিন আলহাজ সুলাইমান সিদ্দিকী। শিক্ষাজীবন শুরু হয়— জৈনপুরের জিয়াউল উলুম মাদরাসায়। তার দাদা তাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেন। ফার্সি সাহিত্য নিয়ে তিনি ওখানে পড়াশোনা করেন।

এরপর মাদরাসাতুল ইসলাহতে সংযুক্ত হন। মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা হামিদুদ্দীন আল-ফারাহী। সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে ভারতের লাখনৌস্থ ভারতের বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামাতে চলে যান। সেখান থেকে বিএ আলিমিয়্যাহ ডিগ্রি এবং হাদিসশাস্ত্রে এমএ (ফার্স্ট ক্লাস) সমাপ্ত করেন। এছাড়াও সৌদি আরবের কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সেও অংশ নেন।

পড়াশোনার সময়কালে প্রতিটি ক্লাসে তিনি সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষার্থী ছিলেন। তবে নিয়মিত তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করতেন।

পাঁচ শতাধিক বিখ্যাত আলেমের অনুমতি
হাদিস-বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছেন। দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার নামকরা মুহাদ্দিসদের (হাদিসবেত্তা) কাছে পড়েছিলেন। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও দরদি দাঈ আল্লামা আবুল হাসান আলি নদভী, ভারতের বিখ্যাত হাদিসবিশারদ ইউনুস জৌনপুরি (রহ.), মুসলিম উম্মাহর গর্ব ও সিরিয়ার বিখ্যাত আলেম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.), অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম ব্যক্তিত্ব ড. ইউসুফ আল কারাদাভি ও আল্লামা আবদুর রশিদ নুমানির সান্নিধ্যে সময় কাটিয়েছেন।

আশ্চর্যরকম তথ্য হলো— পাঁচ শতাধিক বিখ্যাত আলেমের কাছ থেকে হাদিসের ইজাজত (হাদিস বর্ণনার অনুমতি) নিয়েছেন।

নদওয়া থেকে অক্সফোর্ডে
তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর  সরাসরি তত্ত্বাবধানে দারুল উলুম নদওয়াতেই শিক্ষকতা-জীবন শুরু করেন। সেখানে চার বছর শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি লাখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং আরবি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি অর্জন করেন।

১৯৮৯ সালে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী মিয়া নদভী (রহ.) অক্সফোর্ডে ইসলামিক সেন্টার স্থাপন করেন। ১৯৯১ সালে অক্সফোর্ড-কর্তৃপক্ষ কয়েকজন তরুণ গবেষক চাইলে আলী মিয়া নদভী (রহ.) ড. আকরাম নদভীকে অক্সফোর্ডে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

শায়খ আকরাম নদভী প্রথমে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেও উস্তাজের আদেশসূলভ অনুরোধ মেনে নেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দেন। সেখানে গিয়ে ভারতীয় সূফি, খানকাহ্ ও মাদরাসা— এসব নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর ২০১৩ সাল থেকে ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ও আস-সালাম ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

বিভিন্ন ভাষায় তাঁর গ্রন্থ
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী আরবি, উর্দু ও ইংরেজিতে ৩০ টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজিতে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে আছে— দ্য গোল্ডেন রুল অব ডিফারিং, আল-ফিকহ আল-ইসলামি, জার্নি টু আন্দালুস, বুস্তান আল-মুহাদ্দিসিন, উসুল আশ-শাশি, মাদরাসা লাইফ : অ্যা স্টুডেন্টস লাইফ অ্যাট নদওয়াতুল উলামা, লেসন্স লার্নড : ট্রেজার্স ফ্রম নাদওয়াস সেজেস, ইফ দ্য ওয়েশেন্স ওয়্যার ইন্ক : অ্যান আনলাইকলি ফ্রেইন্ডশিপ অ্যান্ড অ্যা জার্নি টু দ্যা হার্ট অব দ্য কোরআন, আবু হানিফা : হিজ লাইফ, লিগ্যাল ম্যাথড অ্যান্ড লিগ্যাসি, আল-মুহাদ্দিসাত : দ্য ওমেন স্কলারস ইন ইসলাম ইত্যাদি।

শেষের আগে
দুই যুগের ধরে তার গবেষণা-এষণার ধরন কেমন ছিল, কী কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন— এগুলো তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে লিখেছেন। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ঘরোয়া মজলিসগুলোতে আলোচনা করেছেন। সেগুলো নিয়ে লেখা ও আদান-প্রদান করা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

অঁজপাড়া জৌনপুরের বিদ্যুৎহীন গ্রামের সাধারণ বালক ছিলেন ড. আকরাম নদভী। দুরন্ত শৈশব ও  বর্ণালি কৈশোরের প্রতি বিকেলে পরিবারের মহিষগুলো নিয়ে ঘরে ফেরা ছিল তার কাজ— অথচ সেই কিশোরের হাতে সম্পন্ন হয়েছে ঐতিহাসিক ও মহান এই কর্ম-গাথা।

আল্লাহ তাআলা ড. আকরাম নদভী, তাঁর শিক্ষকবৃন্দ, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।