যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের আলো ছড়াচ্ছে বাংলাদেশের ফাতিহা আয়াত। ছবি : সংগৃহীত

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় একটা শিশুর ভিডিও। কখনো ক্যামরার পেছনে দাঁড়ান গণিত শেখাতে। কখনো বিজ্ঞানের নানান খুঁটিনাটি। কখনো কোডিং, আবার কখনোবা কোরআনের অর্থসহ টিউটোরিয়ালে শান্তির বার্তা শেখাচ্ছে শিশুকিশোরদের। প্রতিনিয়ত তৈরি করেছে সমবয়সীদের জন্য শিক্ষাবিষয়ক এমন নানান ভিডিও কন্টেন্ট।

শিশুটির নাম ফাতিহা আয়াত। তবে ফাতিহা নামেই অধিক পরিচিত। বয়স আট পেরিয়ে নয় এর কোটায় পা বাড়িয়েছে। এই বয়সের শিশুরা চকলেট নিয়েই খুশি থাকে সারাদিন। আর ফাতিহা নানা ব্যতিক্রমী কাজ নিয়ে।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফাতিহা নিউইয়র্ক সিটির শিক্ষা বিভাগের গিপ্টেন অ্যান্ড টেলেন্ট প্রোগ্রামের ফোর্থ গ্রেডের শিক্ষার্থী। বাবা ব্যারিস্টার আফতাব আহমেদ। মা সালমা আকতার একজন স্কুল শিক্ষিকা। ফাতিহা বাবা-মা'র সাথে নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসে বাস করেন।

উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ম্যাককিনল। সেটা দেখতে আলাস্কা প্রদেশের সুমেরু বৃত্তে বেড়াতে গিয়েছিল ফাতিহা। তখন বয়স ৭। গিয়ে দেখে— পাহাড়সম সুবিশাল হিমবাহ থেকে সাগরে ভেঙে পড়ছে বরফখণ্ড, যে কারণে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ফলে ভূপৃষ্ঠের বাড়ছে তাপমাত্রা। ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ফাতিহা। মনে পড়ে যায় তার নিজের দেশের ছোট্ট একটা বদ্বীপের কথা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যেটি একদমই উঁচুতে নয়।

নিউইয়র্কে ফিরে এসেই ফাতিহা ছুটল জাতিসংঘে। কীভাবে ফাতির যাত্রা শুরু হলো— জাতিসংঘের সদর দপ্তরে? তা আমরা শুনে নিই ফাতিহার মুখেই।  টিবিএন টুয়েন্টি ফোরে ‘আমাদের সাতকাহন’ এক সাক্ষাৎকারে ফাতিহাকে এমন প্রশ্ন করা হলে— ফাতিহা জানায়, ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। জাতিসংঘ ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের অনুষ্ঠান করে দুইদিন পর ১৩ অক্টোবর। ১৩ অক্টোবর আমার জন্মদিন। সে বছর বাবা-মা চেয়েছিলেন আমাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা চমক দিতে। তারা ওই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ইকোসক চেম্বারে নিয়ে যান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কানাডার নারীবিষয়ক মন্ত্রী মারিয়াম মোনসেফ তার অফিসিয়াল ভাষণে আমার কথা উল্লেখ করেন এবং হলভর্তি বিভিন্ন দেশের প্রায় সাতশ' ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি আমাকে করতালি দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। এরপর থেকেই আমার জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার আগ্রহ হয় এবং একের পর এক সুযোগও আসতে থাকে।

ফাতিহার কথার যাদুতে মুগ্ধ মানুষ। আমেরিকার বুকে নিজেকে মেলে ধরেছেন যেন আমেরিকার বুকে বাংলার এক টুকরো নক্ষত্র। আমেরিকার ন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াড অনারেবল মেনশন হয়েছেন। আমেরিকার জ্যাকসন হাইটসে এই জাতীয় গণিত প্রতিযোগিতায় ফাতিহার হাতে বাংলাদেশি পতাকা দেখে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- এটা তো আন্তর্জাতিক কোনো ইভেন্ট নয়, তা সত্ত্বেও তুমি তোমার নিজের দেশের পতাকা বহন করছ কেন? তার উত্তরে ফাতিহা বলেন- আমার দেশের কেউ যেহেতু আগে কখনও এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেনি, তাই আমি নিজের এই অর্জনকে দেশের সবার অর্জন বলে মনে করছি। এই পুরস্কার আমি বাংলাদেশের সব গণিতপ্রেমী শিক্ষার্থীকে উৎসর্গ করেছি। 
  
আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেল ২০১৯ সনে রমজান মাসব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল রামাদান উইথ ফাতিহা। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিল ফাতিহা।

গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষায় প্রচলিত নিয়মের বাইরে নিত্যনতুন পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে গণিত ও বিজ্ঞানের ভীতি দূর করার প্রয়াসের সে কাজ করছে। তার ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রতিনিয়ত দিচ্ছে অসংখ্য টিউটোরিয়াল।

ফাতিহা মনের ভেতর স্বপ্ন বুনেন একদিন মহাকাশচারী হবেন। মহাকাশে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়াবে।তাইতো ফাতিহা বাবার সাথে কেনেডি স্পেস সেন্টারে ২৭ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকারী বিখ্যাত নভোচারী ‘ডন থমাস’ এর সাথে সাক্ষাৎ করে নভোচারী হওয়ার জন্য মূল্যবান দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে। অ্যাস্ট্রনট ডন থমাস  এর সাথে মিশন কন্ট্রোল রুম ঘুরে এসে ফাতিহা ঘরের এক কোণে বানিয়েছে নিজের ব্যক্তিগত স্পেস রিচার্জ কর্নার নাম দিয়েছে বায়তুল আয়াত বা ‘আয়াতের ঘর’। ফাতিহা নিজের ঘরকেই একটা গবেষণাগার বানিয়ে নিয়েছে।

ফাতিহা কোডিং শিখে নিজেই তৈরি করছেন অ্যাপস। এই পর্যন্ত ফাতিহার ‘সিস্টার রিইউনিয়ন’ ও ‘বিআর উইথ অ্যা বিআর’ নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কালার্স অব আর্ট হিউম্যানিটি'তে প্রদর্শিত হয়েছে ফাতিহার অসংখ্য আর্ট।

 নানা বিষয় নিয়ে ফাতিহা সচেতনতা গড়ে তুলতে কাজ করছে। জাতিসংঘ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছেন অসংখ্য বক্তব্য। ১৬তম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলন ২০১৯, ইউএন ডে এবং উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাজেন্ডাতে অংশ নিয়ে শিশু নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য, পারিবারিক সহিংসতায় শিশুদের সমস্যা, শরণার্থী শিশুদের অমানবিক জীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেছে। এছাড়াও ভয়েস অব আমেরিকা, রাশান টিভিতে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার। আমরা যখন গাছ কাটি,আইসক্রিম খেয়ে যেখানে সেখানে খোসা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করি ছোট্ট ফাতিহা তখন পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদ করে। এই বয়সের শিশুকিশোররা সাধারণত কথা বলতেই ভয় পায় মানুষ দেখলে লুকিয়ে যায়, আর় ফাতিহা শিশুদের আনন্দময় শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলেন জনসম্মুখে।

ফাতিহা চায় বড় হয়ে এমন কিছু করে বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখতে, যেন আর একটি শিশুও ক্ষুধাকাতর দিন না কাটায়। তাই ফাতিহা গড়ে তোলেছে ‘চিল এন্ড ডি' নামে সহযোগী সংগঠন। যেখান থেকে শিশুদের অধিকার, সুরক্ষা ও ক্লাইমেট চেইঞ্জ নিয়ে কাজ করা হয়। টিভি চ্যানালের সাক্ষাৎকারে ফাতিহা বলেন, যদি জেনেটিক সায়েন্টিস্ট হই, বিভিন্ন খাবারের ডিএনএ প্রোফাইল আবিস্কার করে সেগুলোকে শিশুদের জন্য আরও বেশি পুষ্টিকর করতে চাই। ফাতিহা বলেন, কী হতে চাই জানি না, কিন্তু যা-ই হই না কেন, চাই সেই পেশাটা হোক শিশুদের জন্য। একটি নতুন পৃথিবী তৈরি হোক শিশুময়।

বহুমাত্রিক মেধার জন্য অল্প বয়সেই ফাতিহা অর্জন করেছে এন আর বি স্পেশাল টেলেন্ট অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকার ন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াড অনারেবল মেনশন খেতাব, পেরিনিয়াম ম্যাথ টুর্নামেন্ট রিজিওনাল রাউন্ডে প্রথম, ন্যাশনাল অ্যাডভেনা আর্ট কম্পিটিশনে  অ্যামেজিং আর্টিস্ট এওয়ার্ড সহ অসংখ্য পুরস্কার।