যেভাবে কোরবানি দেওয়ার বিধান চালু হয়েছিল
আল্লাহর জন্য পশু উৎসর্গ দেওয়াকে কোরবানি বলে। কোরবানি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ইবাদত। আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরবানি করতে উৎসাহ দিয়েছেন। যারা সামর্থ্যবান তাদের জন্য ওয়াজিব। আর যারা করবেনা, তাদের রাসুল (সা.) ভর্ৎসনা করেছেন।
কোরবানির সূচনা হয় আদিপিতা হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে। তার ছেলে হাবিল ও কাবিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি দিয়েছিল। হাবিলের ইখলাস ও নিষ্ঠা ছিল, তিনি সত্যের ওপর ছিলেন। তাই তার কোরবানি গৃহীত হয়েছিল। কাবিল ছিল অসত্যের ওপর। তাই তার কোরবানি কবুল হয়নি।
বিজ্ঞাপন
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তাদের আদমের দুই পুত্রের কাহিনি শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করল, একজনের কোরবানি কবুল হলো, অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না।’ (সুরা আল মায়েদা, আয়াত : ২৭)
ইসলামী ইতিহাসের কিতাবপত্রে রয়েছে—
যখন আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার শুরু হয় তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা— এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। এরূপে ৪০ জোড়া সন্তান প্রসব করেন। মা হাওয়া (আ.)। আল্লাহর নির্দেশে আদম (আ.) এক গর্ভের পুত্রের সঙ্গে অন্য গর্ভের কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। তখনকার সময়ে অন্য কোনো মানুষ না থাকায়— শরিয়তের বিধান এটিই ছিল।
হাবিল-কাবিলের বিয়ে
এ নীতি ও প্রথা অনুযায়ী বিয়ের বয়সে উপনীত হলে হাবিল ও কাবিলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন আদম (আ.)। হাবিলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন কাবিলের সঙ্গে জন্মগ্রহণ করা কন্যা— আকলিমার সঙ্গে। আকলিমা ছিলেন পরমা সুন্দরী। আর কাবিলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন হাবিলের সঙ্গে জন্মগ্রহণ করা কন্যার সঙ্গে। তিনি দেখতে অতোটা সুন্দর ছিলেন না। আর এতেই কাবিল এ বিয়েতে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
তখন হজরত আদম (আ.) উভয়কে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘যার কোরবানি গৃহীত হবে সে-ই আকলিমার পাণি গ্রহণ করবে।’ তৎকালে কোরবানি গৃহীত হওয়ার নিদর্শন ছিল— আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে কোরবানিকে ভস্মীভূত করা। হাবিল ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি কোরবানি করলেন। কাবিল কৃষিকাজ করতেন। তিনি কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কোরবানি করার জন্য পেশ করলেন।
আল্লাহ তাআলা হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন। আকাশ থেকে একখণ্ড আগুন এসে হাবিলের কোরবানি জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু কাবিলের কোরবানিকে আগুন স্পর্শই করেনি।
কোরবানি ছিল সব নবী-রাসুলের যুগে
কোরবানির প্রচলন সব নবী-রাসুলের যুগে ছিল। তবে কোরবানির নিয়ম-বিধি ও রীতিনীতি ছিল ভিন্নতর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির নিয়ম নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা (জীবিকা হিসেবে) আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)
আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)
নবী-রাসুলদের মধ্যে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্থান শীর্ষে। তাঁর উপনাম আবুল আম্বিয়া—নবীদের আদি পিতা, আবুল মিল্লাত— মুসলমানদের জাতির পিতা। সাতজন ছাড়া সব নবী-রাসুল তাঁর বংশ থেকে এসেছেন। তিনিই মুসলমান নামটি প্রথম রেখেছেন।
ইবরাহিম শব্দটি সুরিয়ানি শব্দ। অর্থ আবে রাহিম— দয়ালু পিতা। শিশুদের প্রতি দয়ালু ছিলেন বলে এ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জান্নাতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সারা মুমিনদের অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত শিশুদের দায়িত্বশীল হবেন। (তাফসিরে কুরতুবি : প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৭৩)
যেখানে প্রেরিত হন হজর ইব্রাহিম (আ.) ও লুত (আ.)
হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা নবী হিসেবে ফিলিস্তিনে ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় নবী করে প্রেরণ করেন। একই সময় তাঁর ভাই হারানের পুত্র লুত (আ.)-কে জর্দান ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার নবী করে প্রেরণ করেন।
লুত (আ.)-এর জাতি তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেনি, বরং তারা নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা কয়েকজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাঁরা লুত (আ.)-কে তাঁর কওমের শাস্তির সংবাদ দিয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে গমন করেন।
বৃদ্ধ বয়সে পেলেন সন্তানের সুসংবাদ
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর বয়স তখন ৮৬ বছর। তাঁর কোনো সন্তান না থাকায় সদা আল্লাহ তাআলার দরবারে দোয়া করতেন, ‘হে আমার রব! আমাকে কোনো নেক সন্তান দান করুন।’ (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০০)
আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করে ফেরেশতাদের অবহিত করলেন যে তোমার একটি সন্তান হবে। যেমন আল্লাহর বাণী : ‘অতঃপর আমি তাঁকে এক ধৈর্যশীল পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দান করলাম।’ (সুরা : আস-সাফফাত, আয়াত : ১০১)
এই সন্তানকেই দিতে হবে কোরবানি
বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে পুত্রসন্তান দান করেন। তাঁর নাম রাখেন ইসমাঈল। পিতৃ-মাতৃস্নেহে ইসমাঈল (আ.) ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। তখনই আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে পরীক্ষা করার ইচ্ছা করেন, ‘সে কি তার পুত্রকে বেশি ভালোবাসে, নাকি আমাকে ভালোবাসে।’
হজরত ইবরাহিম (আ.) ক্রমাগত তিন রাত স্বপ্নে দেখেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে, ‘তুমি ওই পাহাড়ে যাও এবং তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো।’ হজরত ইবরাহিম (আ.) উট কোরবানি করলেন; কিন্তু তার পরও একই স্বপ্ন দেখছেন, ‘তোমার প্রিয় জিনিস কোরবানি করো।’
অতঃপর তিনি বুঝতে পারলেন যে আল্লাহ তাআলা আমার ছেলেকেই কোরবানি করতে বলছেন। নবীদের স্বপ্নও অহি। তাই তিনি পুত্রকে কোরবানি করার ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন।
কোরবানি দিতে গিয়ে পুরস্কৃত হন যেভাবে
আল্লাহ তাআলা ঘটনাটি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন, ‘অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন পিতা তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী বলো? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে আপনি ধৈর্যশীল পাবেন। (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০২)
এরপর আল্লাহ সেই ঘটনার কথা এভাবে বলেন—
‘অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম স্বীয় পুত্রকে জবেহ করার জন্য কাত করে শায়িত করল এবং তখনই আমি তাকে উদ্দেশ করে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যি পালন করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০৩-১০৭)
আল্লাহ মনোনিত সর্বশেষ ধর্ম ইসলামেও কোরবানি
এ ধরায় কি এমন কোনো পিতা আছেন, যিনি তাঁর হৃদয়ের ধন পুত্রকে নিজ হাতে জবেহ করতে পারেন? কিন্তু হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর প্রেমে এতই উদ্বুদ্ধ ও পাগলপারা ছিলেন যে কঠিনতর আদেশ স্বেচ্ছায় হাসিমুখে বরণ করে নিতে ত্রুটি করেননি।
মিল্লাতে ইবরাহিমের সে মহান কোরবানির সূত্র ধরেই আমাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) সুযোগ রেখেছেন— মহান এই ইবাদতের। ত্যাগ ও বিসর্জনের এই নিঃশর্ত আনুগত্যের। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ স্মৃতি ও উৎসর্গ এখনও বহাল আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।