ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি কী?
ধর্ষণ কতটা নিকৃষ্ট, নোংরা ও জঘন্য কাজ— তা বলা বাহূল্য। ধর্ষকের জন্য দুনিয়া-আখিরাতে কঠোর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অন্য সব মতবাদের ধর্ষণকে যেভাবে ভিন্নতার সঙ্গে ও অন্য আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করেছে, ইসলাম অগ্রহণযোগ্যতা ইসলাম রাখেনি। কারণ, বিবাহবহির্ভূত যেকোনো যৌন সম্পর্কই ইসলামের দৃষ্টিতে নির্ঘাত বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য।
ফলে ইসলাম ব্যভিচারী ও ধর্ষক উভয়ের জন্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করেছে। ইসলামি ফিকাহ ও আইনশাস্ত্র মোতাবেক ধর্ষকের শাস্তিও ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। তবে অনেক ইসলামি আইনজ্ঞরা ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
ধর্ষণ ও ব্যভিচার স্পষ্ট হারাম
শিরক ও হত্যা কবিরা গুনাহ। এই দুইটির পর ব্যভিচার বড় ধরনের অপরাধ ও সুস্পষ্ট হারাম কাজ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা আল ইসরা, আয়াত : ৩২)
এই আয়াতে ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ ইমাম কুরতুবি (রহ.) গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘ব্যভিচার করো না’-এর চেয়ে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’— এটি অনেক বেশি কঠোর কথা।”
এর সহজ অর্থ হলো- যেসব বিষয় ও কাজ ব্যভিচারের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, তা হারাম। এসব ক্ষেত্রে যা কিছু ভূমিকা রাখে, সেগুলোও হারাম।
ইসলাম ধর্ষককে যে শাস্তি দিয়েছে
অনেক হাদিসে ধর্ষণের শাস্তির ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলাম বিষয়টির স্পর্শকাতরতা স্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ধর্ষকের শাস্তি এবং ধর্ষিতার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
উল্লেখ্য, যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত রয়েছে, সেগুলোকে ‘হদ’ বলে।
অন্য হাদিসে আছে, ‘গনিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণাাধীন এক দাস জোরপূর্বক ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে যায়। উমর (রা.) ওই গোলামকে বেত্রাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে (অপকর্মে) সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কোনো ধরনের বেত্রাঘাত করেননি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৯৪৯)
ধর্ষিতার করণীয় কী?
ধর্ষণ ব্যভিচারের সমগোত্রীয় হলেও তার চেয়ে ভয়ংকর অপরাধ। ব্যভিচারের পাশাপাশি ধর্ষণও কবিরা গুনাহ। কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে।
সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২, তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১)
ইসলামি আইনবিদরা একমত হয়েছেন যে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)
ইসলামে ব্যভিচারের যে শাস্তি
বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে আমৃত্যু পাথর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শরিয়তে ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তার শাস্তি রজম বা পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী; তাদের প্রত্যেককে ১০০ কশাঘাত করবে...।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২)
এই শাস্তি প্রয়োগের অধিকার একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসনের। অন্য কারও এখানে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। হাদিসে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখিরাতে।
দুনিয়ার তিনটি হলো— এক. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া। দুই. দরিদ্রতা। তিন. অকালমৃত্যু।
আর আখিরাতের তিনটি হলো এক. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, দুই. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা। তিন. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই. ফা. পৃষ্ঠা : ১০৯)
ধর্ষক— ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যভিচারী ও নির্যাতক
ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর অন্যপক্ষ নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারী ধর্ষকের শাস্তি হবে।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় অবধারিতভাবে সংঘটিত হয়। এক. ব্যভিচার। দুই. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত ব্যভিচারের শাস্তি বরাদ্দ। পরেরটির জন্য ইসলামি আইনজ্ঞদের এক অংশ বলে, ‘মুহারাবা’র শাস্তি হবে। মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্য কোথাও অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার উভয়টিই হতে পারে।
মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টির অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ষোলো বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোলো বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’
এই সংজ্ঞার সঙ্গে ইসলামের তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে এতে কিছুটা অসামঞ্জস্য রয়েছে। ইসলাম সম্মতি-অসম্মতি উভয় ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু দেশীয় আইনে কেবল অসম্মতির ক্ষেত্রে অপরাধ বলা হয়েছে পার্থক্য এইটুকুই।
ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে যে শাস্তি
সম্মতি ছাড়া বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ইসলাম ও দেশীয় আইন এবং সাধারণের কাছে অপরাধ হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু না হলে তার মৃত্যুদণ্ড নেই। কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামে বিবাহিত কেউ ব্যভিচার করলে তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা রয়েছে।
আইনে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে, প্রথমে ধর্ষক ব্যভিচারের শাস্তি পাওয়ার হত্যার শাস্তি পাবে। যদি অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়, তাহলে ‘কিসাস’ বা মৃত্যুদণ্ড। আর যদি এমন কিছু দিয়ে হয়, সাধারণত যা দিয়ে হত্যা করা যায় না; তাহলে অর্থদণ্ড। যার পরিমাণ একশ উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় কোটি টাকা)।
ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কোনো অপরাধ ঘটে— যেমন অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা ও ওই ধরনের ভিডিও প্রচার করা ইত্যাদি। তাহলে যদি এসব অপরাধ পাওয়া যায়, তাহলে শাস্তির পরিমাণ আরও বেশি হবে।