প্রতীকী ছবি

মানুষ হত্যা বা কোনো একজনের জীবন কেড়ে নেওয়া কেমন? কাউকে এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরের জন্য অবশ্যই গভীর চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন হবে না। যে কেউ বলে দিতে পারবে হত্যা, অন্যায়ভাবে কারো জীবন কেড়ে নেওয়া পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য কাজ। এর থেকে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না।

অথচ বর্তমানে অহরহ হত্যাকাণ্ড ঘটছে। একে অপরকে মেরে ফেলছে। নিজের তুচ্ছ স্বার্থ অথবা নিজের মতের বিপরীতে অবস্থানের কারণে অন্যকে সহ্য করতে না পেরে তাকেই বিদায় করে দিচ্ছে পৃথিবী থেকে। যিনি ভিন্নমত সহ্য করতে না পেরে অন্যকে শেষ করে দিলেন, সরিয়ে দিলেন পৃথিবী থেকে, তিনি অন্যদের এক ধরনের বার্তা দিলেন ভবিষ্যতে তার বিপক্ষে অবস্থান না নিতে। কেউ বিপক্ষে অবস্থান নিলে তারও একই পরিণতি হতে পারে জানিয়ে দিলেন সরাসরি।

এই যুদ্ধাংদেহী বা একরোখা মনোভাব কোনো চিহ্নিত অপরাধীর মাধ্যমে সংঘটিত হলে কষ্ট করে হলেও মানুষ তা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথবা রবের কাছে এর ফলাফল পাওয়ার চেষ্টায় চোখ মুছে শান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু তা যদি সমাজের নিরীহ পরিচিত কারো মাধ্যমে সংঘটিত হয় অথবা এই সংঘাত ভ্রাতৃঘাতি রূপ ধারণ করে তাহলে অন্যরা শান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করবে কোত্থেকে! 

অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে তা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা সমতুল্য বলে অভিহিত করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। বর্ণিত হয়েছে—

যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যার বিনিময় অথবা ভূপৃষ্ঠে ফ্যাসাদ সৃষ্টির কারণ ছাড়া অন্যায়ভাবে হত্যা করলো সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করলো। আর যে ব্যক্তি কাউকে অবৈধ হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা করলো সে যেন সকল মানুষকেই রক্ষা করলো। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)

আল্লাহ তায়ালা হত্যাকাণ্ডের পরিণতি হিসেবে জাহান্নামকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। বর্ণিত হয়েছে—

আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তার মধ্যে সে সদা সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন ও তাকে অভিশাপ দেবেন। তেমনিভাবে তিনি তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি। (সূরা নিসা, আয়াত : ৯৩)

পরকালের শাস্তি ছাড়াও হত্যাকারীর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে মর্মপীড়া দেওয়ার মতো দুঃসংবাদ। যারা নিজের পেশী শক্তি বা অন্যকে সহ্য করতে না পেরে হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধে জরিয়ে পড়ে তাদের জন্য তওবা কবুল না হওয়ার দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে হাদিসে। 

বর্ণিত হয়েছে, ‘হত্যাকৃত ব্যক্তি হত্যাকারীকে সঙ্গে নিয়ে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার সামনে উপস্থিত হবে। হত্যাকৃত ব্যক্তির মাথা তার হাতেই থাকবে। শিরাগুলো থেকে তখন রক্ত পড়বে। সে আল্লাহ তায়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, হে আমার প্রভু! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে হত্যাকারীকে আরশের অতি নিকটেই নিয়ে যাবে।’ 
 
শ্রোতারা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে হত্যাকারীর তওবা করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সুরাহ নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতটি তিলাওয়াত করে বললেন, উক্ত আয়াত রহিত হয়নি। পরিবর্তনও হয়নি। অতএব তার তওবা কোনো কাজেই আসবে না। (তিরমিজি ৩০২৯)

মুসলিম হিসেবে একজন অপরাধী অন্তত এতোটুকু ধারণা করেন যে সবকিছু শেষে কোনো একদিন সে হয়তো তওবা করবে। আপন রবের কাছে ফিরবে। রব তার সব পাপ মুছে নিষ্কলুষ করবেন। সে নতুন জীবন পাবে কিন্তু মানুষ হত্যার পাপটি তাকে অপবিত্রতা মুছে পবিত্র হওয়ার সুযোগ দেবে না। পাপী অন্তর নিয়েই কিয়ামতের দিন রবের সামনে উপস্থিত হতে হবে। এর থেকে বড় মর্মপীড়ার আর কিছু হয়তো নেই একজন মুসলিমের জন্য। 

আর কখনো ভ্রাতৃঘাতি কোনো সংঘাত শুরু হলে এ বিষয়ে মিমাংসার কথা বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। বর্ণিত হয়েছে—

আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন। (সূরা হুজরাত, আয়াত : ৯)

ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের পরিস্থিতি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, এমন ঘটনায় উভয় পক্ষই জাহান্নামী বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, যখন দু'জন মুসলিম পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ের অবস্থান হবে জাহান্নাম। (সহিহ বুখারি)

এসব জঘন্য অপরাধ, হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়ে চলেছেন আলেমরা। হত্যাকাণ্ড কতটা জঘন্য এ নিয়ে রাসূলের হাদিসের বাণী সবাই শুনছেন, সবাই জানছেন। তবে জানাশোনার মাঝেই বন্দি সব। মেনে চলার কোনো প্রবণতা নেই কারো মাঝে। হাদিসের বাণী যেন শুধু বলেই মুখের সুখ, শুনেই কানের প্রশান্তি।

অথচ জেনেও আমল না করা ব্যক্তির সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 

كَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰهِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ

আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপার যে, তোমরা বলবে এমন কথা যা তোমরা কর না। (সূরা সফ, আয়াত : ৩)