গারে সাওরে নবীজি সা. ও আবু বকর রা.-এর সময় কেটেছে যেভাবে
মক্কা থেকে মদীনা অভিবাসন বা হিজরত মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার কাফেররা যখন নবীজি সা. এবং তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাকে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। এই ঘটনার এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলো আল্লাহর রাসূল সা. এবং তাঁর প্রিয় সঙ্গী হজরত আবু বকর রা. এর গারে সাওরে অবস্থানের সময়। এই সময়টিকে ইসলামী ইতিহাসে এক সাহসিকতা ও আল্লাহর সাহায্যের অসাধারণ উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
হিজরতের প্রেক্ষাপট এবং পরিকল্পনা
বিজ্ঞাপন
মক্কায় নবীজি সা. ও সাহাবিরা যখন কাফিরদের নিপীড়নের শিকার হন, তখন আল্লাহ তায়ালা ইসলাম প্রচার-প্রসারের জন্য মদীনাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন। ৫৩ বছর বয়সে নবীজি সা. আল্লাহর নির্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন।
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসূল সা.-এর মক্কা থেকে মদিনার এই যাত্রা পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসে 'হিজরত' নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময়, নবীজি সা. এবং তাঁর প্রথম সহচর হজরত আবু বকর রা. মক্কার কাফিরদের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় গোপনে মক্কা ছাড়তে শুরু করেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা, ৩৪৬ – ৩৪৯)
হিজরতের পথ শুরু হওয়ার আগেই নবীজি সা. ও আবু বকর রা. আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী গারে সাওরে আশ্রয় নেন। গারে সাওর মক্কার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি পাহাড়ে অবস্থিত একটি গুহা, যা তখন এবং আজও ইসলামী ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত। (সীরাতু রাসূলুল্লাহ, মুহাম্মাদ হায়াৎ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা, ৪৭–৫৫)
গারে সাওরে নবীজি সা. এবং আবু বকর রা.-এর নিরাপদ আশ্রয়
গারে সাওরে অবস্থানকালে নবী সা. এবং আবু বকর রা. সম্পূর্ণ গোপনীয়তায় ছিলেন। কাফিররা যখন জানলো যে, নবী সা. এবং আবু বকর রা. মক্কা ছাড়ার পরিকল্পনা করেছেন, তারা তাঁদের ধরতে পুরো শহরে খোঁজ শুরু করলো। নবী সা. ও আবু বকর রা. নিজেদের জীবন রক্ষা করতে গুহায় আশ্রয় নিলেন। গুহায় অবস্থানকালে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ সাহায্য আসে (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩২৩২)
খুঁজতে খুঁজতে কাফেররা গুহার কাছাকাছি চলে এলো। তবে তারা গুহার মুখে নেকড়ের পায়ের ছাপ দেখতে পেলো। এরই মধ্যে গুহার মুখে আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো—এক গুচ্ছ মাকড়সা গুহার মুখে জাল বুনলো, মাকড়সার সেই জালে বাসা বাঁধলো দুটি কবুতর। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবীজি সা. এবং আবু বকর রা.-এর নিরাপত্তার নিশ্চিতের জন্য এই অলৌকিত ঘটনার অবতারণা করা হয়েছিল।
গুহার কাছে নেকড়ের পায়ের ছাপ আর কবুতরের বাসা দেখে কাফেরদের মনে ধারণা জন্ম নিলো, সম্ভবত নবীজি সা. এবং তাঁর সঙ্গী ইতিমধ্যে মদীনায় চলে গেছেন। এই ভুল ধারণার ফলে কাফেররা তাদের অনুসন্ধান বন্ধ করে দিলো। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা, ৩৪৬–৩৪৯)
আল্লাহর সাহায্য
গারে সাওরে অবস্থানকালে আবু বকর রা. নবীজির পাশে ছিলেন। কাফেররা যেন গুহার কাছে আসতে না পারে তা নিয়ে আবু বকর রা.সতর্ক ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। কাফেররা নবীজি সা. ও আবু বকর রা.-কে খুঁজতে খুঁজতে গুহার এতোটা কাছে চলে এসেছিল যে, তাদের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এতে আতঙ্কিত হয়ে আবু বকর রা. নবীজি সা.-কে বলেছিলেন, ‘যদি তারা নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, তবে তারা আমাদের দেখতে পাবে।’ নবীজি সা. উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুমি কী ভাবছ? আমাদের সঙ্গে তো আল্লাহ রয়েছেন?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩২৩২)
আরও পড়ুন
এই ঘটনার মাধ্যমে নবীজি সা. তাঁর সঙ্গী আবু বকর রা.-কে দৃঢ়ভাবে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে শিখিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকেই মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আসে—কোনো বিপদ বা সংকটে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গারের সাওর থেকে আবারো যাত্রা শুরু
গারে সাওরে নবী সা. এবং আবু বকর রা. প্রায় তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। তিনদিন পর কাফেরদের কমে গেলে তাঁরা গুহা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তাঁদের হিজরতে পথ ছিল একদম নতুন ও বিপদসঙ্কুল। এই পথে তাদের সাহায্যকারী ছিলেন আল্লাহ তায়ালা। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা, ৩৪৬–৩৪৯)
ইসলামের ইতিহাসে গারে সাওরের গুরুত্ব
গারে সাওরের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটি শুধুমাত্র সাহসিকতার গল্প নয়, বরং এটি আল্লাহর সাহায্য, বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাসের এক চিরন্তন উদাহরণ। নবীজি সা. এবং আবু বকর রা. এর এই নির্ভীক যাত্রা ইসলামী সমাজে নতুন উদ্যম ও শক্তি প্রদান করেছিল। গারে সাওরের ঘটনা মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়েছে যখন একজন সৎ এবং বিশ্বাসী আল্লাহর পথে চলতে থাকে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাহায্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।
মোট কথা গারে সাওরে নবীজির সা. এবং আবু বকর রা.-এর কাটানো সময় ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য মুহূর্ত। তাদের এই সাহসিকতা এবং আল্লাহর সাহায্যের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আজও মুসলিমদের জন্য একটি অমূল্য শিক্ষা। এই ঘটনাটি আল্লাহর প্রেরিত বাণী পৃথিবীজুড়ে পৌঁছানোর এক নির্ভীক পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত। এর ফলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। গারে সাওরের ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক অমলিন অধ্যায়, যা আমাদের শেখায়, আল্লাহর পথে চলতে কোনো ভয় বা দ্বিধা নয়, বরং ঈমান এবং আস্থার সাথে চলতে হবে।