ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসা— ০১
কোরআনে আল-আকসা মসজিদ নিয়ে যা বলা হয়েছে
ফিলিস্তিন— একটি আহত ও ক্ষতবিক্ষত আঙিনা। লাখো শ্বাপদের দলের পাশবিকতা ও ইহুদিদের রক্ষচক্ষুর হিংস্রতায় মানবতা যেখানে আজ বাকরুদ্ধ। ইসরায়েলিদের দ্বারা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন ও নিপীড়নে চলছে অনবরত। মজলুম মুসলিমদের হাহাকারে প্রকম্পিত হচ্ছে— ফিলিস্তিন ও আল-কুদসের আকাশ-বাতাস চারদিকে।
ইসলামের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা ও মসজিদে আকসাকে সমূলে ধ্বংস করাই ইহুদিদের প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথেই হাঁটছে দখলদার ইহুদিরা।
বিজ্ঞাপন
আল-কুদস, মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মাকদিস কিংবা বাইতুল মুকাদ্দাস। পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর বুকে অবস্থিত সমগ্র মুসলিম জাতির প্রাণস্পন্দন।
মসজিদুল আকসা ফিলিস্তিনের মাটিতে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকলেও ইসরায়েলিদের মুহুর্মুহু গুলি ও বোমা বর্ষণে নারী-শিশুদের রক্তে রঞ্জিত তার প্রাঙ্গণ। আল-কুদস ও আল-আকসা মসজিদ স্বাধীন হয়েও বর্তমানে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
দখলদার ইহুদি-খ্রিস্টানদের দখলকৃত যেকোনো মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধার করা— সমগ্র মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য। তবে ইসলামের প্রথম কিবলার দেশ ফিলিস্তিনের বিষয়টি অন্যসবগুলোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে ফিলিস্তিনের বাড়তি বৈশিষ্ট্যই তার মাঝে এনে দিয়েছে ভিন্নতা, নিজস্বতা। প্রিয় পাঠক! চলুন মুসলমানদের কাছে মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিন অসামান্য মর্যাদা-বৈশিষ্ট্য ও প্রাণাধিক প্রিয় হওয়ার নেপথ্য-রহস্য উম্মোচন করি।
মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনের অসামান্য মর্যাদা-বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় পবিত্র আল-কোরআন:
এক. ফিলিস্তিন বরকতময় ভূমি ও কল্যাণের আকর
পবিত্র কোরআন তার পাঠককে মসজিদে আকসা ও ফিলিস্তিনকে নানাভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেও তার বিশেষত্ব বর্ণনায় এ একটি আয়াতই যথেষ্ট। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুজিযা মিরাজ ও ইসরার আলোচনা করতে গিয়ে মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত- যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি- যাতে আমি তাকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ০১)
দুই. শিরক এবং পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত ভূমি
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ইসলামের তৃতীয় পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনকে পবিত্রতম ও বরকতময় নগরী হিসেব আখ্যায়িত করেছে। পবিত্র কোরআন ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’ (সুরা মায়িদাহ, আয়াত : ২১)
তিন. নবী-রাসুলের হিজরতভূমি ও আবাসস্থল
যুগে যুগে মানবজাতির হেদায়াতের জন্যে প্রেরিত মহামানবরা অস্বীকারকারীদের হাতে বর্বরোচিত নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অস্বীকারকারীরা তাদের অনেককে শুধু নিপীড়ন করে ক্ষান্ত হননি; কাউকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছেন, কাউকে বা জানে মারার হুমকিও দিয়েছেন। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলে আল্লাহ তাআলার নির্দেশক্রমে তারচেয়ে নিরাপদ ও দাওয়াতের অনুকূল কোনো শহরে কিংবা দেশে তারা হিজরত করেন। পবিত্র কোরআন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও লূত আলাইহিস সালামের নমরুদের অধিকারভূক্ত দেশ হতে অন্যত্রে হিজরত প্রসঙ্গ এসেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে সে দেশে পৌঁছিয়ে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্যে অফুরন্ত কল্যাণ রেখেছি।’ (সুরা আম্বিয়াহ, আয়াত : ৭১)
আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাসের জন্যে পর্বত ও পক্ষীকুলকে বশীভূত করেছেন, যারা তার আওয়াজের সাথে তাসবিহ পাঠ করতো, তেমনি সুলায়মান আলাইহিস সালামের জন্যে বায়ূকে বশীভূত করে দিয়েছেন। বায়ুতে ভর দিয়ে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে কল্যাণময় দেশে দ্রুততম সময়ে ও অতি সহজে গমনাগমন করতেন।
এ প্রসঙ্গে মহাগন্থ আল কোরআনে এসেছে— ‘আমি প্রবল বায়ুকে সুলায়মানের অধীনে করে দিয়েছিলাম; তা তার আদেশে প্রবাহিত হতো ওই দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ দান করেছি।’ (সুরা আম্বিয়াহ, আয়াত : ৮১)
ফেরাউনের নির্যাতন ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ বনি ইসরাঈলকে আল্লাহ তাআলা তার হাত থেকে উদ্ধার করে বরকতময় ও কল্যাণময় ভূমির উদয়াচল ও অস্তাচলের অধিপতি করেছেন এ মর্মে পবিত্র কোরআন উল্লেখ করেন-
‘আর যাদের দুর্বল মনে করা হতো তাদেরও আমি উত্তরাধিকার দান করেছি এ ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের, যাতে আমি বরকত সন্নিহিত রেখেছি। আর বনি ইসরাঈলের ধৈর্যধারণের দরুণ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত কল্যাণ। ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় যা কিছু তৈরি করেছিলো সে সবকিছু আমি সমূলে ধ্বংস করেছি। আর তাদের নির্মিত সুউচ্চ ও গগণচুম্বী সুবিশাল টাওয়ারও আমি মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৩৭)
কল্যাণময় ভূমি প্রদানের মাধ্যমে সাবাবাসীদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে এসেছে—
‘তাদের এবং যেসব জনপদের লোকদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অনেক দৃশ্যমান জনপদ আমি স্থাপন করেছিলাম এবং সেগুলোতে ভ্রমণ নির্ধারিত করেছিলাম। তোমরা এসব জনপদে রাত্রে-দিনে নিরাপদে ভ্রমণ কর।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৮)
মহান আল্লাহ মারয়াম (আ.) ও তার মাতাকে অবস্থানযোগ্য টিলায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য শুনুন-
‘আমি মারয়াম তনয় ও তার মাতাকে এক নিদর্শন দান করেছিলাম এবং তাদেরকে এক অবস্থানযোগ্য স্বচ্ছ পানি বিশিষ্ট এক টিলায় আশ্রয় দিয়েছিলাম।’ (সুরা আল-মুমিনুন, আয়াত : ৫০)
আরও পড়ুন : সেন্ট পিটার্সবার্গ নীল মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য
উপর্যুক্ত আয়াতসমূহে কল্যাণময় ও বরকতময় স্থান হিসেবে যে অঞ্চল ও দেশকে নির্দেশ করা হয়েছে, ইবনু আব্বাসের মতে তা হলো গয়গম্বরদের পীঠস্থল ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসা।
চার. ফিলিস্তিনের বিশেষ ফল নিয়ে আল্লাহর শপথ
মহান আল্লাহ তাআলা আসমানি প্রত্যাদেশ অবতরণের প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মাকদিসের দুটি বিশেষ ফলের শপথ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শপথ ডুমুর ও যায়তুনের’। (সুরা ত্বিন, আয়াত : ০১)
তাফসিরবিশারদরা বলেন, ডুমুর ও যায়তুন ফলের দেশ হলো বায়তুল মাকদিস। আল্লাহকর্তৃক কোনো অঞ্চলের বিশেষ কিছুর শপথ করার ফলে— সে অঞ্চল ও উক্ত ফলের গুরুত্ব বহু অংশে বেড়ে যায়। এভাবেই পবিত্র কোরআন ফিলিস্তিন ও মসজিদুলর আকসার পরিচয় ও তার স্বতন্ত্রতা বর্ননা করেন।
হাদিসে মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনের মর্যাদাবিষয়ক লেখাটি পরের কিস্তিতে প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ।