মুসয়াব ইবনে উমায়ের রা.
ছিলেন মক্কার আয়েশী যুবক, তার শাহাদাতে অঝোরে কেঁদেছিলেন রাসূল সা.
মক্কার অভিজাত পরিবারের সুদর্শন, মেধাবী যুবকদের একজন ছিলেন মুসয়াব ইবনে উমায়ের রা.। বাবার নাম উমায়ের। মায়ের নাম খুনাস বিনতু মালেক। পারিবারিক আভিজাত্য কৌলিন্যে বেড়ে উঠেছিলেন। যে যুগের চমৎকার সব পোশাক ও উৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সৌখিন যুবক ছিলেন। সৌন্দর্য, সুরুচি, সৎ মানসিকতার পাশাপাশি তাঁকে সুন্দর একটি মন দিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালা।
মক্কার অলিগলিতে ইসলাম মুসলমানের বিরোধিতা
বিজ্ঞাপন
তাঁর যৌবনের সময়টাতে মক্কায় ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত মক্কার পরিবেশে কেউ ইসলামের আগমনকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। অলিগলির আড্ডায়, আলোচনা, পরামর্শ সভায় প্রায় সবাই ইসলাম, মুসলমান ও মুহাম্মদ সা.-কে নিয়ে বিষোদগারে ব্যস্ত। ইসলামের আলো কীভাবে নিভিয়ে দেওয়া যায় সেই পরামর্শ সবার মুখে।
মুসয়াব রা. প্রায় এসব আড্ডায় অংশ নিতেন। বয়সে ছোট হলেও বংশ, কৌলিন্যের কারণে সবাই তাঁকে সমীহ করতো। কোনো আড্ডায় অংশ নিলে তিনিই হয়ে উঠতেন মধ্যমণি।
দারুল আরকামে মুসয়াব রা.
আল্লাহর রাসূল সা. মক্কার অদূরে পাহাড়ের পাদদেশে দারুল আরকামে সাহাবিদের গোপনে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিতেন। মুসয়াব একদিন নবীজির এই মজলিসে গেলেন। নবীজির ওপর তখন কোরআনের একটি আয়াত নাজিল হলো। কোরআনের বাণীর সুষমা তাঁকে আকৃষ্ট করলো। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন।
ইসলামের কথা গোপন রাখলেন মুসয়াব রা.
মুসয়াব তাঁর মাকে প্রচন্ড ভয় পেতেন। মায়ের ভয়ে ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন। কিন্তু তাঁকে নামাজ পড়তে ও দারুল আরকামে যেতে দেখলেন মক্কার কেউ একজন। খবর ছড়িয়ে পড়লো বাতাসের সঙ্গে। নেতৃস্থানীয়দের সামনে উপস্থিত করে জবাবদিহিতা চাওয়া হলো মুসয়াবের কাছে। তাঁকে বুঝানো হলো, ইসলাম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা হলো।
মুসয়াবের আয়েশী জীবনের রাশ টানলেন মা
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর অন্তরকে ঈমানের আলোয় আলোকিত করেছিলেন। কোনো অন্ধকারের বার্তা তাঁকে স্পর্শ করতে পারলো না। উল্টো তিনি সবাইকে কোরআনের আয়াত শুনিয়ে ইসলামের দিকে আহ্বান করলেন। তাঁর মা প্রচন্ড রেগে গেলেন। ছেলেকে সবার সামনে মারধর করলেন। তাঁকে ঘরে বন্দি করলেন। তবে কোনো কিছুই মুসয়াবকে ইসলাম থেকে ফিরাতে পারলো না।
ইসলাম থেকে ফিরাতে না পেরে মা ছেলের খাওয়া-দাওয়া আয়েশী জীবনযাপন সব বন্ধ করে দিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত মুসয়াবের কাছ থেকে এসব কেড়ে নিলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো সে মুহাম্মদ সা.-এর ধর্ম ত্যাগ করবে। তবে মুসয়াবের মায়ের কোনো চেষ্টাই সফল হলো না।
আবিসিনিয়ায় হিজরত
এরমধ্যে মুসলমানদের অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন। বিলাশী জীবনের মোহ ছেড়ে ইসলামের জন্য সুযোগ বুঝে তিনিও হিজরত করলেন। হিজরতের পর মক্কায় ফিরলে মা তাঁকে আবারো আটকের চেষ্টা করলেন। তখন তিনি তাঁর মাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আমাকে আটকের চেষ্টা করা হলে যারা বন্দি করতে আসবে তাঁদের সবাইকে হত্যা করবো।
মুসয়াবের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কছেদ
ছেলের এমন বেপরোয়া স্বভাবের কথা খুব ভালো করেই জানতেন তিনি। তাই আর আটক করলেন না। মাতৃত্ব সুলভ মমতা তাঁর ভেতর কাজ করলেও সামাজিকতা ও মিথ্যা আভিজাত্যের অহংবোধে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বললেন, যেখানে ইচ্ছা যাও, আমাকে আর মা ডাকবে না।
মায়ের প্রতি মুসয়াবের মায়া হলো, তিনি বললেন, আপনার জন্য আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনি শুধু একবার বলুন, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।
জবাবে মা বললেন, তোমার ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজের বুদ্ধিজীবীরা আমাকে নিবোর্ধ, মুর্খ ভাববে, আমার মতামত ও বুদ্ধিকে গুরুত্ব দেবে না, তুমি তোমার পথে চলে যাও।
বিলাশী জীবনের মোহ ছেড়ে মক্কার রাস্তায়...
এভাবেই ইসলামের জন্য পারিবারিক আভিজাত্য, বংশ কৌলিন্য, আয়েশী জীবন ছেড়ে মক্কার রাস্তায় নেমে আসেন মুসয়াব রা.। এক সময় মক্কার দামী সব পোশাক, উৎকৃষ্ট সুগন্ধি, উন্নত সুবিধা ভোগ করলেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর অভাব ঘিরে ধরলো তাঁকে। কোনোদিন খাবার পেতেন আবার কোনোদিন অনাহারে কাটাতেন। দামী পোশাক ছেড়ে শতছিন্ন মোটা তালিযুক্ত পোশাক পরতেন।
সাহাবিদের সামনে জীর্ণশীর্ণ তালিযুক্ত পোশাকে মুসয়াব রা.
একদিন নবীজি সা. সাহাবিদের নিয়ে একটি মজলিসে আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ জীর্ণশীর্ণ চামড়ার তালিযুক্ত একটি পোশাক পরে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুসয়াব রা.। পোশাকে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। তাঁকে দেখে সবার মাঝে এক ধরনের ভাবান্তর সৃষ্টি হলো। সবার দৃষ্টি নত হয়ে এলো। কারো কারো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
সবার চোখে ভেসে উঠলো মুসয়াব রা.-এর সেই আয়েশী জীবনের চিত্র। যা তিনি শুধু ইসলামের জন্য ছেড়েছিলেন নির্দ্বিধায়।
এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা. মুচকি হেসে বললেন, মক্কায় মুসয়াবের থেকে মা-বাবার আদরের দুলাল, শৌখিন কোনো যুবক আমি দেখিনি। সে শুধু আল্লাহ তাঁর রাসূলের ভালোবাসায় সবকিছু ত্যাগ করছে।
মদিনায় ইসলামের শিক্ষক হিসেবে...
রাসূল সা. মুসয়াব রা.-কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হিজরতের আগে মদিনায় মুসলমানদের ইসলামি শিক্ষার জন্য প্রথম দূত হিসেবে তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন । তিনি মদিনায় যাওয়ার সময় সেখানে মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জন। পরের বছর হজের সময় ৭২ জনের কাফেলা নিয়ে রাসূল সা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।
উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহন
বদর যুদ্ধে মুসয়াব রা. গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। উহুদ যুদ্ধের শুরুতে রাসূল সা. তাঁর হাতে মুসলিম বাহিনীর পাতাকা তুলে দেন।
যুদ্ধের শুরুতে মুশরিক বাহিনীর পরাজয় এক রকম নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মুসলিম তীরন্দাজরা রাসূল সা. নির্দেশ পালনে ভুল করলে সুনিশ্চিত বিজয় পরাজয়ে পরিণত হয়।
সুযোগ বুঝে কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের ওপর আকস্মিক হামলা করে বসে। মুসলিম বাহিনী বিশৃ্ঙ্খল হয়ে পড়ার সুযোগে কুরাইশরা রাসূল সা.-কে ঘিরে ফেলে।
আরও পড়ুন
রাসূল সা.-কে ঘিরে ধরলো শত্রু বাহিনী
মুসয়াব রা. পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে যতটুকু সম্ভব পতাকা উঁচু করে নেকড়ের মতো হুঙ্কার ছাড়তে লাগলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাসূল সা. থেকে শত্রুদের দৃষ্টি তাঁর নিজের দিকে ফিরিয়ে আনা।
এক হাতে পতাকা অন্য হাতে তরবারি
এক হাতে পতাকা ধরে অন্য হাতে তরবারি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। শত্রু বাহিনী তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে রাসূল সা.-এর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে।
মক্কার আদরের দুলালের অন্তিম মুহূর্ত
মক্কার আদরের দুলাল মুসয়াব ইবনে উমায়ের রা.-এর অন্তিম মুহূর্ত নিয়ে ইবনে সাদ বর্ণনা করেন—
উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে মুসয়াব রা. একাই পতাকা উঁচিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। অশ্বারোহী ইবনে কামীয়া এগিয়ে এসে তরবারির আঘাতে তাঁর ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসয়াব রা. তখন বলে উঠেন, ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইন্না রাসূল, কাদ খালাত মিন কালিহির রুসূল— মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছু নন, তাঁর পূর্বে আরও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।
মুসয়াব বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। তরবারির অন্য একটি আঘাত এসে তাঁর বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তিনি আবারও একি কথা বলে পতাকাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই বাহু দিয়ে তুলে ধরলেন। এরপর তাঁর ওপর বর্শা নিক্ষেপ করা হয়। তিনি পতাকাসহ মাটিতে ঢলে পড়েন।
শাহাদাতের পূর্বে মুসয়াব রা. বারবার সেই বাক্যটিই উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন। অথচ তখনো সেটি কোরআনের আয়াত হিসেবে নাজিল হয়নি। উহুদের ঘটনার পরই এটি কোরআনের আয়াত হিসেবে নাজিল হয়।
শহীদ মুসয়াবের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন রাসূল সা.
যুদ্ধ শেষে হজরত মুসয়াব রা.-এর লাশটি খুঁজে পাওয়া গেল। রক্ত ও ধুলোবালিতে একাকার তাঁর চেহারা। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন রাসূল সা.।
‘ইজখীর’ ঘাস
তাঁকে দাফনের জন্য একটি প্রস্থ চাদর ছাড়া আর কোনো কাপড় পাওয়া গেল না। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা, পা থাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেষ রাসূল সা. বললেন, মাথার দিকে যতটুকু ঢেকে দেওয়া যায় দাও, পায়ের দিকে ‘ইজখীর’ ঘাস দিয়ে ঢেকে দাও।
শহীদ মুসয়াবের পাশে দাঁড়িয়ে যা বলেছিলেন রাসূল সা.
রাসূল সা. তাঁর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, মুমিনদের এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করে সত্যে পরিণত করেছে। তারপর তাঁর কাফনের চাদরটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি, সেখানে তোমার মতো চাদর ও সুন্দর জুলফী অন্য কারো ছিল না। আজ তুমি এখানে এই ধুলি-মলিন চাদরে আবৃত হয়েছো।
তিনি আরও বললেন, আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছে কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যাদানকারী হবে।
মুসয়াব রা. সম্পর্কে খাব্বাব ইবনে আরাত রা....
মুসয়াব রা.-এর সম্পর্কে খাব্বাব ইবনে আরাত রা. বলেন, আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাসূল সা.-এর সঙ্গে হিজরত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যারা তাঁদের কাজের মোটেও প্রতিদান না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন মুসয়াব তাদের একজন।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১/ ২১৪-২১৯)