প্রতীকী ছবি

বনী ইসরাঈলের নবী হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ১২ সন্তানের একজন ছিলেন হজরত ইউসুফ আ.। সন্তানদের মাঝে ছোট হওয়ায় ইউসুফকে একটু বেশি স্নেহ করতেন নবী ইয়াকুব আ.। মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্য ভাইয়েরা ইউসুফের প্রতি বাবার স্নেহের বিষয়টি ঈর্ষাকারত দৃষ্টিতে দেখতো। 

ঈষার কারণে তারা ইউসুফকে বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। একদিন সব ভাই মিলে খেলারছলে ইউসুফকে বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে গেল। এবং খেলার নাম করে এক সময় তাকে কূপে নিক্ষেপ করলো। 

তাদের ধারণা ছিল কূপের পাশের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো কাফেলা হয়তো পানি তোলার সময় ইউসুফকে দেখতে পাবে এবং তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে। এতে করে ইউসুফ মৃত্যুর হাত থেকেও বেঁচে যাবে, বাবার কাছ থেকেও দূরে থাকবে। তার প্রতি বাবার ‘মাত্রাতিরিক্ত’ স্নেহ-মমতা দেখে আমাদেরও আর ঈর্ষান্বিত হতে হবে না।

ইউসুফ আ.-কে কূপে নিক্ষেপের পর ভাইয়েরা তার বাবা কাছে গিয়ে মিথ্যা গল্প বুনলো। বাবাকে বললো, আমরা খেলার সময় ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি। ইয়াকূব আ.-কে তাদের কথা বিশ্বাস করানো জন্য তারা বাড়িতে যাওয়ার সময় একটি ছাগল জবাই করে ইউসুফের কাপড়ে রক্ত মাখিয়ে নিলো, যেন রক্তমাখা কাপড় দেখে বাবা তাদের কথা সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে নেন।

পবিত্র কোরআনে তাদের এই ছলনার কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে—


وَجَاؤُوْا أَبَاهُمْ عِشَاءً يَّبْكُوْنَ، قَالُوْا يَا أَبَانَا إِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا يُوْسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَأَكَلَهُ الذِّئْبُ وَمَا أَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صَادِقِيْنَ، وَجَآؤُوْا عَلَى قَمِيْصِهِ بِدَمٍ كَذِبٍ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْراً فَصَبْرٌ جَمِيلٌ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُوْنَ-

‘তারা (ভাইয়েরা) রাতের বেলায় কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এল’। ‘এবং বলল, হে পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আসবাবপত্রের কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম। এমতাবস্থায় তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী’। ‘এ সময় তারা তার মিথ্যা রক্ত মাখানো জামা হাজির করল। 

(এটা দেখে অবিশ্বাস করে ইয়াকূব বললেন, কখনোই নয়) বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটা কথা তৈরী করে দিয়েছে। (এখন আর করার কিছুই নেই), অতএব ‘সবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা কিছু বললে তাতে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত : ১৬-১৮)।

ভাইয়েরা ইউসুফ আ.-কে কূপে নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার পর তিনি তিন দিন একা অন্ধকার কূপে ছিলেন। এরপর হঠাৎ একটি ব্যবসায়ী কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসরে যাওয়ার পথে সেই কূপের পাশে যাত্রা বিরতি দিলো। পিপাসা নিবারণের জন্য তারা কূপে বালতি ফেললো। বালতি তোলার পর দেখলো বালতিতে পানি নেই, পানির পরিবর্তে উঠে এলো সুন্দর এক বালক।

যিনি কূপে বালতি ফেলেছিলেন তিনি অনিন্দ্য সুন্দর এই বালককে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন ‘কি আনন্দের কথা। এ যে সুন্দর এক বালক!’ 

সে যুগে মানুষ বেচাকেনা হতো পণ্যের মতো। তাই তারা বালক ইউসুফ আ.-কে দেখে মালিকবিহীন পণ্যদ্রব্য মনে করে লুকিয়ে ফেলল। 

অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করে ব্যবসায়ী কাফেলা ইউসুফ আ.-কে বিক্রির জন্য মিসরের বাজারে উপস্থিত করল। মানুষ কেনা-বেচার সেই হাটে এই অনিন্দ্য সুন্দর বালককে দেখে বিত্তশালী খরিদ্দাররা রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করল। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে মর্যাদার স্থানে সমুন্নত করতে চেয়েছিলেন। তাই সব খরিদ্দারকে ডিঙিয়ে মিসরের তৎকালীন অর্থ ও রাজস্বমন্ত্রী ক্বিৎফীর তাকে চড়ামূল্যে খরিদ করে নিলেন। ক্বিৎফীর ছিলেন নিঃসন্তান।

তিনি ইউসুফ আ.-কে ক্রয় করে তাকে নিজের স্ত্রীর হাতে সমর্পণ করলেন এবং বললেন, একে সন্তানের মতো লালন-পালন করো। ভবিষ্যতে সে আমাদের কল্যাণে আসবে’। 

মূলত ইউসুফ আ.-এর সুন্দর চেহারা ও নম্র-ভদ্র ব্যবহারে তাদের মধ্যে সন্তানের মমতা জেগে ওঠে। ক্বিৎফীর তার দূরদর্শিতার মাধ্যমে ইউসুফের মধ্যে ভবিষ্যতের অশেষ কল্যাণ দেখতে পেয়েছিলেন। আর সেজন্য তাকে ভালোভাবে যত্ন সহকারে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِن مِّصْرَ لاِمْرَأَتِهِ أَكْرِمِيْ مَثْوَاهُ عَسَى أَن يَّنْفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَداً وَكَذَلِكَ مَكَّنِّا لِيُوْسُفَ فِي الأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِنْ تَأْوِيْلِ الأَحَادِيْثِ وَاللهُ غَالِبٌ عَلَى أَمْرِهِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ- (يوسف ২১)-

‘মিসরে যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করল, সে তার স্ত্রীকে বলল, একে সম্মানজনকভাবে থাকার ব্যবস্থা কর। সম্ভবত, সে আমাদের কল্যাণে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করে নেব। এভাবে আমরা ইউসুফকে সেদেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং এজন্যে যে তাকে আমরা বাক্যাদির পূর্ণ মর্ম অনুধাবনের পদ্ধতি বিষয়ে শিক্ষা দেই। আল্লাহ স্বীয় কর্মে সর্বদা বিজয়ী। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত : ২১)।