প্রখ্যাত আলেম শায়খ হামজাহ হাসানী নদভী (রহ.)

ইলম-জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যাকাশের আলোকিত নক্ষত্রগুলো ধারাবাহিকভাবে খসে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্বের অনেকে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আমার নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নদওয়াতুর উলামাও এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত। নদওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বহু ইসলামি ব্যক্তিত্বেরও এই করোনায় জীবনাবসান হয়েছে।

বিখ্যাত উর্দু কবি আল-উসতাজ রাঈসুস শাকেরি নদভীর ইন্তেকালের পরপরই নাদওয়ার ট্রেজারার আল-উসতাজ আতহার হোসাইন নদভীও বিচ্ছেদের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলেন।

এখনো তাদের বিদায়ের দৃশ্য দেশ-বিদেশের নদভীদের চোখের উপর ভাসছে, তাদের আলোচনাও চলছে সর্বত্র। সেই দুঃখ কাটিয়ে ওঠারও সুযোগ মেলেনি এখনো। আর এরই মাঝে আমাদের কর্ণকুহরে ভেসে এলো— আরও একটি বড় দুঃখের সংবাদ। যে সংবাদ শুনতেই হৃদয় কেঁপে উঠলো। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো।
 
কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে বারবার এই শিরোনামের সংবাদ দেখে পরিশেষে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করতে হয়েছে যে, দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার সহ-পরিচালক ও হাসানী বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান সৈয়দ হামজাহ হাসানী নদভী (১৯৫০-২০২১) আজ সালাতুল আসরের পরপরই ‘কারওয়ানে রাফতা’ বা চলে যাওয়াদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

উসতাজ হামজাহ হাসানী নদভী হাসানী বংশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। তার বাবা সৈয়্যাদ মুহাম্মাদ সানী নদভী (১৯২৫-১৯৮২) সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন কলমযোদ্ধা ছিলেন। নদওয়ার একজন শ্রেষ্ঠ উসতাজ ছিলেন। তিনি শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়ার (১৮৯৮-১৯৮২) খলিফা এবং আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভীর (১৯১৩-১৯৯৯) ভাগিনা ছিলেন।

ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরীলীর তাকিয়া কিলান গ্রামে হাসানীদের আঙিনায় ১৯৫০ সালে হামজাহ হাসানী নদভী জন্ম লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি নদওয়ার মা’হাদে লাভ করেন। অতঃপর নদওয়া থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। তার উস্তাজদের মধ্যে এখনো যারা জীবিত আছেন— তারা হলেন : নাদওয়ার বর্তমান রেক্টর আল্লামা রাবে হাসানী নদভী এবং আল বা‘সুল ইসলামী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. সাঈদ আল-আজমী নদভী। (এখানে উল্লেখ্য যে, নিবন্ধ লেখকও ১৯৮৬ সালে সেই মা‘হাদের ক্লাস এইটের ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে নদওয়া থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।)

মরহুম হামজাহ হাসানী নদভী নদওয়ার ছাত্র থাকাকালে আল্লাম আবুল হাসান আলী নদভীর সঙ্গে সারাক্ষণ সময় কাটাতেন। দেশ-বিদেশের সফরেও তার সঙ্গী হতেন। তার সঙ্গে থেকে আল্লামা নদভীর বৈশিষ্টগুলো তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করতেন। বরং ধারণ করেছেন— বললেও অতিরঞ্জিত হবে না।

স্বভাবগতভাবে তিনি তাসাওউফের প্রতি দুর্বল ছিলেন। সূফি ও সাধক প্রকৃতির একজন একনিষ্ঠ আল্লাহ ও তার রাসুলপ্রেমিক ছিলেন। তার সময়ের সূফি সিলসিলার সব বুজর্গদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক  ছিলো। তাদের ইন্তেকালের পর তিনি তার শ্বশুর ও নদওয়ার বর্তমান রেক্টর আল্লামা রাবে হাসানী নাদভীর সংস্পর্শে থেকে দ্বীনি খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে আসছিলেন।

তিনি তার বাবার ইন্তেকালের পর থেকে লাখনৌর আমিনাবাদ থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘রেদওয়ান’ উর্দু পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। উক্ত পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সম্পাদকীয় ছাড়াও প্রবন্ধ লিখতেন। নদওয়ার ছাত্ররা ছাড়াও পুরো ভারতের মুসলমানদের মাঝে সেই বিরদওয়ার পত্রিকার অনেক গুরুত্ব ছিল। আমরা প্রতি মাসে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে থাকতাম।

তিনি একজন সমাজসংস্কারও ছিলেন। সামাজিক বহু কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে হলো— তিনি রায়বেরলীতে সানী হাসানী সোসাইটি নামে একটি কল্যাণজনক ও সেবামূলক সামাজিকপ্রতিষ্ঠান করেছেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধীনে তিনি জামেয়া উম্মুল মুমিনিন আয়েশা লিল-বানাত’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেই প্রতিষ্ঠানটি এখন তার জন্য সাদাকায়ে জারিয়া হয়ে থাকল।

এছাড়াও তিনি নদওয়া থেকে প্রকাশিত ‘তা’মীরে হায়াত’ উর্দু পত্রিকার পরামর্শকের দায়িত্বও পালন করছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নদওয়ার গভর্নিং বডির একজন সক্রিয় সদস্যও ছিলেন। নদওয়ার মুফতিয়ে আজম রাঈসুল ফুকাহা এবং নায়েবে নাজেম মুফতি যাহুর আলম নদভীর (১৯২৭-২০১৬) ইন্তেকালের পর হতে তিনি নদওয়ার নায়েবে নাজেমের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন।

আমি নাদওয়ার ছাত্র থাকাকালে (১৯৮৬-১৯৯৬) তাকে কাছ থেকে দেখেছি। তার সাথে আমার গভীর সম্পর্কও ছিলো। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বিশেষ করে প্রতি রমজানে আমি যখন আল্লামা নদভীর গ্রামের বাড়ি রায়বেরলীতে মেহমানদের মেহমানদারির দায়িত্ব পালন করতাম, তখন তিনি আমার কর্মতৎপরতায় খুব মুগ্ধ ছিলেন। সবার কাছে আমার প্রসংশা করতেন।

স্বভাবগতভাবে তিনি চুপচাপ থাকা পছন্দ করতেন। তবে সত্যি কথা হলো— এটি হাসানী পরিবারের একটি বৈশিষ্ট্য। তারা আমাদের মতো কখনো গল্প ও আড্ডায় মেতে উঠতেন না। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একটি শব্দও যেমন বলতেন না— ঠিক তেমনিভাবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এক টুকরা রুটিও কখনো বেশি খেতেন না। আমি দীর্ঘ ১১ বছর তাদের কাছে থেকে— আমি নিজ চোখে এমনটা দেখেছি।

সমষ্টিগতভাবে পরিবর্তন বা সংশোধনের চেয়ে তিনি ব্যক্তি সংশোধনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। যার প্রভাব নদওয়ার পরিবেশে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তার দায়িত্বকালীন সময়ে নদওয়ার পরিবেশ কিছুটা ব্যতিক্রম হয়ে উঠে। ছাত্র-শিক্ষক সবার মাঝে মত-বিরোধ দেখা দেয়। অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা জন্ম নেয়। ছাত্রদের মাঝে প্রচন্ড রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।

এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি তার সূফি-স্বভাব ত্যাগ করে পর্দার আড়াল হতে বের হয়ে ছাত্রদের সামনে এসে— সরাসরি ছাত্রদের সাথে কথা বলে অস্থিরতা নিরসনের চেষ্টা করেন। তাদের অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেন। তবে সত্য কথা হলো— তার মত দরবেশ এবং ফিরেশতা-চরিত্রের মানুষের কাছে সমস্যা সমাধানের আশা করার অর্থ হলো— হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর মতো মানুষের কাছে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে তীর নিক্ষেপের আশা করা। কারণ তিনি খুবই কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন।

তারপরও সত্য কথা হলো, তিনি নদওয়ার জন্য একজন মুখলিস অভিভাবক এবং মিল্লাতের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তাই তার মানবসেবা এবং সঠিক জযবাকে অস্বীকার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করিনা।

এই একটি কারণে হামজা হাসানী নদভীর ইন্তেকালের খবরে আমার হৃদয়ে ভীষণ এক ব্যথা অনুভব হয়েছে। তাই আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নেন এবং তার রেখে যাওয়া পরিবার-পরিজনকে সাবরে জামিল দান করেন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও প্রফেসর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।