রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের সময় সেখানে তিন শ্রেণীর মানুষের বসবাস ছিল। একশ্রেণী ছিল মুসলমান আনসার সাহাবি। অপর শ্রেণী ছিল পৌত্তলিক, যারা আগে থেকেই মদিনায় অবস্থান করছিল। তৃতীয় শ্রেণী ছিল ইহুদি।

এই হুইদিরা রোমীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হেজাযে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এরা ছিল হিব্রু। হেজাযে আশ্রয় নেওয়ার পর চাল-চলন, কথাবার্তা ও পোশাক পরিচ্ছদে তাদেরও আরব মনে হতো। মদিনায় বসবাস শুরুর পর তারা তাদের গোত্র ও সন্তানদের নামকরণও করতো আরবদের মতো। আরবদের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল। এসবের পরেও তারা নিজেদের বংশ-গৌরব নিয়ে অহংকার করতো। তারা নিজেদের ইসরাঈলী অর্থাৎ, ইহুদি হওয়ার কারণে গর্ববোধ করতো। আরবদের মনে করতো নিকৃষ্ট। 

নবীজি সা.-এর হিজরতে সময় মদিনায় ইহুদিদের তিনটি গোত্র বসবাস করতো। 

১. বনু কাইনুকা। এরা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র। এরা মদিনার ভেতরেই বসবাস করতো।

২. বনু নাযির।

৩. বনু কোরাইযা। এ দুটি গোত্র ছিল আওস গোত্রের মিত্র। মদিনার শহরতলী এলাকায় বসবাস করতো এরা। 

মদিনায় সুশৃঙ্খলভাবে বসবাসের জন্য রাসূল সা. সেখানে আগে থেকে অবস্থিত অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন।মদিনায় সব মানুষের সুখে-শান্তি ও নিরাপদ আবাস নির্মাণের জন্য তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে মদিনা ও আশপাশের এলাকার মানুষ একটি সুস্থ প্রশাসনের আওতাভুক্ত হবে। 

মহানবী সা. মদিনায় অবস্থিত অমুসলিম ও ইহুদিদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, সেই চুক্তিতে ইহুদিদের তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। চুক্তির দফাগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—

১. বনু আউফের ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একই উম্মত (একই জাতি) হিসেবে বিবেচিত হবে, ইহুদি ও মুসলমানরা নিজ নিজ দ্বিনের ওপর আমল করবে, বনু আউফ ছাড়া অন্য ইহুদিরাও একই রকমের অধিকার লাভ করবে।

২. ইহুদিরা নিজেদের সমুদয় ব্যয়ের জন্য দায়ী হবে এবং মুসলমানরা নিজেদের ব্যয়ের জন্য পৃথকভাবে দায়ী হবে।

৩. এই চুক্তির আওতাভুক্তদের কোনো অংশের সঙ্গে যারা যুদ্ধ করবে সবাই সম্মিলিতভাবে তাদের প্রতিহত করবে।


৪. এই চুক্তির অংশীদাররা সবাই পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে, তবে সেই কল্যাণ কামনা ও সহযোগিতা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, অন্যায়ের ওপর নয়।

৫. কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের কারণে অপরাধী হবে না।

৬. মজলুমকে সাহায্য করা হবে।

৭. যত দিন যুদ্ধ চলতে থাকবে, তত দিন ইহুদিরাও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।

৮. এই চুক্তির অংশীদারদের জন্য মদিনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকবে।

৯. এই চুক্তির অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে কোনো নতুন সমস্যা দেখা দিলে বা ঝগড়া-বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাসুল (সা.) তার মীমাংসা করবেন।

১০. কোরাইশ ও তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় প্রদান করা হবে না।

১১. ইয়াসরেবের (মদিনার) ওপর কেউ হামলা করলে সেই হামলা মোকাবেলায় পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। সব পক্ষ নিজ নিজ অংশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।

১২. এই চুক্তির মাধ্যমে কোনো অত্যাচারী বা অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৩, ৫০৪)

এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মদিনা ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, সেই রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল মদিনা।