ছোট পাখি আবাবিল। এই ছোট পাখিই ছিল নিপীড়িত মক্কাবাসীর মুক্তির দূত। খোদাদ্রোহী, অত্যাচারী আবরাহা চেয়েছিল মক্কায় অবস্থিত আল্লাহর ঘর কাবা গুড়িয়ে দেবে। বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে এসেছিল সে। এই বিশাল বাহিনীর সামনে প্রতিরোধ গড়ার মতো ক্ষমতা ছিল না মক্কাবাসীর। তারা সাধ্যমতো নিজেদের চেষ্টা শেষে আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রাখেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিরাশ করেননি, রক্ষা করেছিলেন পুরো মক্কা নগরী ও পবিত্র কাবাঘর। আসমান থেকে পাঠিয়েছিলেন আবাবিল পাখি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের বছর মক্কায় এ ঘটনা ঘটে। ইসলাম আগমনের আগেও মানুষজন মক্কায় গিয়ে কাবা তাওয়াফ করতো এবং কাবার সামনে ইবাদত করতো। মক্কার কাবার সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি চক্ষুশূল হয়ে উঠে ইয়েমেনের গভর্নর আবরাহা বিন সবাহর কাছে। 

আবহারা তৎকালীন মানুষেদের মক্কার কাবা থেকে ফেরাতে নিজের রাজ্যে কাবার মতোই দেখতে একটি ঘর নির্মাণে মনস্থির করলো। 

চিন্তাভাবনা করে সে ইয়ামেনের ‘সানা’ নামক জায়গায় মর্মর পাথর দিয়ে বিভিন্ন রকমের কারুকার্য খচিত একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করলো এবং ঘোষণা দিলো আগামীতে যেন মানুষেরা কাবার পরিবর্তে এই নব নির্মিত গির্জায় এসে ইবাদত, উপাসনা, হজ ও তাওয়াফ করে।

কিন্তু প্রকৃত কাবার প্রেমিকরা তার এমন ঘোষণা ও কাবার এই অমর্যাদা-অবমাননা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তার এই ঘোষণা সর্বত্র দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। কুরাইশরা রাগে ফেটে পড়ল। 
কেউ একজন আবরাহার এই কাণ্ডে প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। সে একদিন আবরাহার নির্মিত সেই জাঁকজমকপূর্ণ গির্জায় গোপনে ঢুকে পায়খানা করে এলো। অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরাইশদের একদল যুবক ওই গির্জায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়, যাতে গির্জা পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। 

আবরাহা যে উদ্দেশ্যে গির্জা নির্মাণ করেছিল, সেই উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যর্থ হয়। আরবদেরকে কোনভাবেই যখন আকৃষ্ট করা গেল না, সে ক্রুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। প্রথমে সে আবিসিনিয়ার রাজার কাছ থেকে হাতি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার সৈন্য বাহিনীকে পবিত্র কাবা আক্রমণের নির্দেশ দেয়।

বর্ণিত আছে, ভোরবেলা আবরাহা বাহিনী কাবা ধ্বংসের জন্য অগ্রসর হয়। কোনো বর্ণনায় ২০ হাজার এবং কোনো বর্ণনায় ৬০ হাজার সেনার কথা এসেছে। 

আবরাহা যখন মক্কা অভিমুখে রওনা হওয়ার উদ্যোগ নিলো, হাতিকে মক্কার দিকে হাঁকাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু শত চেষ্টা করেও হাতিকে মক্কামুখী করা গেল না। হস্তি চালকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওদেরকে কাবামুখী করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।

এ সময় হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের দিক হতে সবুজ বর্ণের ঘাড় বিশিষ্ট একদল কৃষ্ণ বর্ণের পাখির আবির্ভাব ঘটল। ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে উড়ে আবরাহার সৈন্যদের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরকণা বর্ষণ করতে লাগল।

পাখিগুলোর মুখে একটি এবং দুই পায়ে দুটি কঙ্কর ছিল, যা ডাল ও গমের মতো। এই কঙ্কর যার মাথায় পড়েছে, সে-ই ধ্বংস হয়েছে। কিছু আঘাতপ্রাপ্তকে মরতে দেখে বাকি সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে শুরু করে।

ইবনু ইসহাক বলেন, আবরাহার বাহিনী মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত মরতে মরতে যায়। আবরাহা সানা শহরে পৌঁছে লোকদের কাছে আল্লাহর আজাবের ঘটনা বলার পর মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তাঁর বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায়। (ইবনে কাসির ও তাফসিরে মুনির)

আবরাহার এই হামলার সময় মক্কার অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল এবং পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করল। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আজাব অবতীর্ণ হলে তারা নিশ্চিন্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যায়। (সিরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩, ৫৬)।