প্রতীকী ছবি

কেউ মারা গেলে শোক প্রকাশের মাধ্যম হিসেব ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ার প্রচলন রয়েছে ধর্মীয় বিধানে। তবে কখনো কখনো কেউ কারো ব্যবহার-আচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে তার মৃত্যু বা বিপদে অনেকে ইন্নালিল্লাহ-এর পরিবর্তে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠেন। এসবের পেছনে থাকে নিজের ওপর করা মৃত ব্যক্তির অত্যাচার-অনাচারের আক্রোশ ও ক্ষোভ প্রকাশ।

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে বুখারি শরিফের রেফারেন্সে একটি হাদিস শেয়ার করতে দেখা গেছে অনেককে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘কারো মৃত্যুকে কেউ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে মৃত ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়’।

জানার বিষয় হলো, বুখারি শরিফে কি সত্যিই এই হাদিস বর্ণিত হয়েছে? হয়ে থাকলে হাদিসের মানসহ জানাবেন প্লিজ।

এছাড়াও আরেকটি বিষয় জানতে চাই, তাহলো— পেশী শক্তি ব্যবহার করে কেউ কারো ওপর অত্যাচার করলে এবং তার বিরুদ্ধে গিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু করার না থাকলে তাদের মৃত্যুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার বিষয়টি ইসলামী শরীয়তে কীভাবে দেখা হয়? মনের ক্ষোভ-আক্রোশ মেটানোর নূন্যতম এই পদ্ধতিটি জায়েজ বলে বিবেচিত হবে কী?

ইসলামি চিন্তাবিদদের মতামত

এমন প্রশ্নের উত্তরে ইসলামি আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদদের মতামত হলো—

কারো মৃত্যুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে তার ওপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায়— হুবহু এমন শব্দ বা রেফারেন্সের কোনো হাদিস বুখারি শরিফে আছে বলে আমাদের জানা নেই।

হাদিসে যা আছে...

তবে সম্ভবত বুখারিতে বর্ণিত একটি হাদীসের মর্মার্থ হিসেবে উপরোক্ত কথাটি ছড়ানো হচ্ছে। সেটি হলো—

أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ يَقُولُ مَرُّوا بِجَنَازَةٍ فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا خَيْرًا فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَجَبَتْ ثُمَّ مَرُّوا بِأُخْرَى فَأَثْنَوْا عَلَيْهَا شَرًّا فَقَالَ وَجَبَتْ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ مَا وَجَبَتْ قَالَ هَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ خَيْرًا فَوَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ وَهَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ شَرًّا فَوَجَبَتْ لَهُ النَّارُ أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللهِ فِي الأَرْضِ

আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক সাহাবি একটি জানাজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁরা তার প্রশংসা করলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ওয়াজিব হয়ে গেল’। একটু পরে পাশ দিয়ে আরেকটি জানাজা গেল। তখন তাঁরা তার নিন্দাসূচক মন্তব্য করলেন। (এবারও) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ওয়াজিব হয়ে গেল’।

তখন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল!) ‘কী ওয়াজিব হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, ‘এ (প্রথম) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা উত্তম মন্তব্য করলে, তাই তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। আর এ (দ্বিতীয়) ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা নিন্দাসূচক মন্তব্য করায় তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেল। তোমরা তো পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী’। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৬৭)

হাদিসের ব্যাখ্যা...

যেহেতু এই হাদিসে খারাপ ব্যক্তি সম্পর্কে নিন্দা করা হয়েছে, তাই বলা হয়েছে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব। আর ভালো ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করা হয়েছে তাই বলা হয়েছে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব।

এখানে মূলত বিষয়টি এমন নয় যে, প্রশংসা ও নিন্দার কারণে সেই দুই ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ও জান্নাত ওয়াজিব হয়েছে। বরং তাদের কৃতকর্মের মাধ্যমেই তাদের জান্নাত ও জাহান্নাম আবশ্যক হয়েছে।

বাকি মানুষ যেহেতু বাহ্যিক আমল ও কর্ম প্রত্যক্ষ করে থাকে, তাই সেই হিসেবে তার ব্যাপারে মন্তব্য করে থাকে যে, লোকটি ভালো ছিল নাকি খারাপ ছিল।

তাই কারো মৃত্যুতে সবাই মিলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেই তার জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যাবে— কেউ এমন ধারণা করলে তা ভুল ধারণা হিসেবে বিবেচিত হবে। বরং তার আমল হিসেবে সে জান্নাতী ও জাহান্নামী হবে।

কারো মৃত্যুতে খুশি হওয়ার বিধান...

দ্বিতীয় যে বিষয়ে প্রশ্ন করছেন সেটির উত্তর হলো—

চিহ্নিত কোনো পেশী শক্তি ব্যবহারকারী জালেম ও অত্যাচারীর মৃত্যুতে খুশি হওয়া জায়েজ আছে। সেই হিসেবে আলহামদুলিল্লাহও বলা যাবে।

তবে কারো ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে পেশী শক্তি ব্যবহারকারী, জালিম হওয়া প্রমাণিত না হলে সন্দেহের বশে কোন মুসলমানের মৃত্যুতে খুশি প্রকাশ করা জায়েজ হবে না। তবে জালিম ও অত্যাচারী হওয়া নিশ্চিত হলে জায়েজ আছে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ بْنِ رِبْعِيٍّ الأَنْصَارِيِّ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُرَّ عَلَيْهِ بِجِنَازَةٍ فَقَالَ مُسْتَرِيحٌ وَمُسْتَرَاحٌ مِنْهُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ مَا الْمُسْتَرِيحُ وَالْمُسْتَرَاحُ مِنْهُ قَالَ الْعَبْدُ الْمُؤْمِنُ يَسْتَرِيحُ مِنْ نَصَبِ الدُّنْيَا وَأَذَاهَا إِلَى رَحْمَةِ اللهِ وَالْعَبْدُ الْفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ الْعِبَادُ وَالْبِلاَدُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ

আবূ কাতাদা বিন রিবয়ী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশ দিয়ে একটি জানাজা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি বললেন, সে শান্তি লাভ করেছে এবং লোকেরাও তার কাছ থেকে শান্তি পেয়েছে। তারা (সাহাবীগণ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এর অর্থ কি? 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুমিন বান্দা দুনিয়ার দুঃখ ও কষ্ট থেকে স্বস্তি লাভ করে এবং পাপী বান্দার মন্দ হতে আল্লাহর বান্দা, গাছ পালা ও জীবজন্তু স্বস্তি পায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫১২, ইফাবা-২০৭৩)

উপরে বর্ণিত হাদিসে অত্যাচারী, পেশী শক্তি ব্যবহারকারী জালেমের মৃত্যুতে মুমিন বান্দার শান্তি লাভের কথা বলা হয়েছে। আর শান্তি ও খুশির খবরে আলহামদুলিল্লাহ বলতে সমস্যা নেই। (বিদায়া-নেহায়া, ১২/৩৩৮)

প্রশ্নটি করেছেন— রাবেয়া খাতুন, শ্যামলী, ঢাকা থেকে

উত্তর দিয়েছেন— মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইসলাম ও জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়ে জানতে এবং ধর্ম সম্পর্কিত খবর, ছবি, ভিডিও পাঠান— dhakapostislam@gmail.com