সূরা হুদ একটি মাক্কী সূরা। সূরাটি সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, আবু বকর রা. একবার জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসূল সা.! কিসে আপনাকে বৃদ্ধ করে দিলো? উত্তরে রাসূল সা. বলেছেন, আমাকে সূরায়ে হুদ, সূরা ওয়াক্বিয়া, আল-মুরসালাত, আম্মা-ইয়াতাসাআলুন ও ইয়া-ইযাশ-শামসু-কুভভিরাত সূরাগুলো বৃদ্ধ করেছে। কোনো কোনো বর্ণনায় সূরা আল-হাক্কাহ এর কথাও রয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩২৯৭) 

অর্থাৎ, এই সূরাগুলোতে বর্ণিত বিষয়বস্তু অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভীতিপ্রদ হওয়ার কারণে এসব সূরা নাজিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এর পবিত্র চেহারায় বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দেয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড, ১২, পৃষ্ঠা, ১৭)

সূরা হুদে যে আলোচনা

এই সূরাটিতে আল্লাহ তায়ালা নবীজি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পূর্ববর্তী সাতজন নবী ও নবীর সঙ্গে সেই যুগের উম্মতের আচরণ ও তাদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

সাত নবী

পূর্ববর্তী সেই নবীরা হলেন— হজরত মূসা আ., নূহ আ., হুদ আ., সালেহ আ., ইবরাহিম আ., লূত আ., শুয়াইব আ.।

মুহাম্মদ সা.-কে শান্ত্বনা

আল্লাহ তায়ালা এই নবীদের উম্মতের বর্ণনার মাধ্যমে হজরত মুহাম্মদ সা.-কে শান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি যখন মক্কার কাফেরদের ইসলামের আহ্বান জানালেন তখন তারা বিশ্বনবী সা.-এর আহ্বানকে ব্যাহত করতে সবধরনের পন্থা অবলম্বন করেছিলো। নবীজির সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কষ্ট, নির্যাতন, হত্যা চেষ্টা, দেশত্যাগে বাধ্য— কোনো কূটচাল বাকি রাখেনি। 

আল্লাহ তায়ালা সূরা হুদে পূর্ববর্তী নবীদের আলোচনা করে রাসূল সা.-কে শান্ত্বনা দিয়েছেন যে, পূর্ববর্তী নবীদেরকেও আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

হজরত মুসা আ. 

এখানে নবীদের ঘটনার আলোচনায় সর্বপ্রথম মুসা আ.-এর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে প্রথমে মুসা আ.-এর উম্মতের কথা বর্ণনা করা হয়নি। বরং নবী মুহাম্মদ সা.-এর রিসালাতের সত্যতা বর্ণনার জন্য তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কোরআন নাজিলের আগে তিনি যেসব আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন তার একটি তাওরাত। এটি মুসা আ.-এর ওপর নাজিল হয়েছে। যারা তাওরাতের ওপর ঈমান রাখে তাদের জন্য নবী মুহাম্মদ সা. ও কোরআনের ওপর ঈমান রাখা আবশ্যক। কারণ সেই কিতাব (তাওরাত) এই কিতাব (কোরআন) ও মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে পথপ্রদর্শক।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—

اَفَمَنۡ كَانَ عَلٰی بَیِّنَۃٍ مِّنۡ رَّبِّهٖ وَ یَتۡلُوۡهُ شَاهِدٌ مِّنۡهُ وَ مِنۡ قَبۡلِهٖ كِتٰبُ مُوۡسٰۤی اِمَامًا وَّ رَحۡمَۃً ؕ اُولٰٓئِكَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِهٖ ؕ وَ مَنۡ یَّكۡفُرۡ بِهٖ مِنَ الۡاَحۡزَابِ فَالنَّارُ مَوۡعِدُهٗ ۚ فَلَا تَكُ فِیۡ مِرۡیَۃٍ مِّنۡهُ ٭ اِنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّكَ وَ لٰكِنَّ اَكۡثَرَ النَّاسِ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ


তারা কি তার সমতুল্য যে তার রব প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যার অনুসরণ করে তার প্রেরিত সাক্ষী এবং যার আগে ছিল মূসার কিতাব আদর্শ ও অনুগ্রহস্বরূপ? তারাই এটাতে ঈমান রাখে। অন্যান্য দলের যারা তাতে কুফরী করে, আগুনই তাদের প্রতিশ্রুত স্থান। কাজেই আপনি এতে সন্দ্বিগ্ন হবেন না। এটা তো আপনার রবের প্রেরিত সত্য, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনে না। (সূরা হুদ, আয়াত : ১৭)

সূরার শুরুতে মুহাম্মদ সা.-এর নবুয়তের প্রমাণ স্বরূপ মুসা আ.-এর আলোচনা করা হলেও সূরার ৯৬ থেকে ৯৯ নম্বর আয়াতে মুসা আ. ও ফিরউনের কাছে রিসালাতের আহ্বান, ফিরাউনের সত্য বিুমখ আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

হজরত নূহ আ.

এই সূরার ২৫ থেকে ৪৮ নম্বর আয়াতে নূহ আ.-এর আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবী হিসেবে প্রেরণের পর তিনি তার উম্মতকে আসমানী ধর্ম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন। তাঁদেরকে পরকালের শাস্তি ও জাহান্নামের আজাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করলেন, কিন্তু কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না।

আল্লাহ তায়ালা এই অবাধ্য জাতিকে বন্যার পানিতে ডুবিয়ে শাস্তি দিলেন। নূহ আ.-কে একটি নৌকা বানাতে বললেন, নৌকায় তিনি তাঁকে ও ঈমানদারদেরকে নিজ অনুগ্রহে রক্ষা করলেন। আল্লাহ তায়ালার ওপর ঈমান না আনার কারণে বন্যায় ডুবে নূহ আ,-এর এক সন্তানও মারা গেল।

হজরত হুদ আ.

নূহ আ. ও তাঁর উম্মতের আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা সূরার ৫০-৬০ নম্বর আয়াতে হুদ আ. ও তাঁর জাতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। হুদ আ.-কে আল্লাহ তায়ালা আদ জাতির কাছে পাঠিয়েছিলেন।

তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহর ইবাদত ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার আহ্বান জানালেন। তিনি তাদের বললেন—

তোমরা যাদের পূজা করছো, তাদের তোমরা নিজেরাই বানিয়েছো। এমনকি তাদের নাম ও অস্তিত্বও তোমাদের বাজে কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। 

তোমরা তোমাদের অতীত পাপের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকো এবং আগামীতে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকো। এ দুটো গুণ (অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।) যার মাঝে থাকবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর জীবন-জীবিকার পথ সহজ করে দেবেন এবং তার কাজও সহজ হয়ে যাবে। আর সবসময় তিনি তাঁর হেফাজত করবেন।

কিন্তু তারা নবীর আহ্বানে সাড়া দিলো না, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বংস করে দিলেন।

হজরত সালেহ আ.

হজরত নূহ ও হুদ আ.-এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরার ৬১-৬৮ আয়াতে সালেহ আ.-এর আলোচনা করেছেন। তিনি সামূদ জাতির কাছে সালেহ আ.-কে নবী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।

তিনি নিজের সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আল্লাহ ছাড়া অন্য যেসব মূর্তির তারা পূজা করতো তা পরিত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের হেদায়েতের পথে আহ্বানের পর তারাও অন্যান্য নবীর উম্মতের মতো সরল-সঠিক পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেও ধ্বংস করলেন।

হজরত ইবরাহিম আ.

এই সূরার ৬৯-৭৬ নম্বর আয়াতে হজরত ইবরাহিম আ.-এর আলোচনা করা হয়েছে। তবে এখানে তাঁর নবুয়তি জীবন ও তাঁর উম্মতের বিবরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি। এখানে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁকে আল্লাহ তায়ালা পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 

হজরত লূত আ.

হজরত মুসা, নূহ, হুদ, সালেহ, ইবরাহিম আ.-এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরার ৭৭-৮৩ নম্বর আয়াতে হজরত লূত আ. ও তাঁর উম্মতের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। 

এই সম্প্রদায় জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য নারীদের বিপরীতে পুরুষের প্রতি আগ্রহী ছিল। এই জঘন্য পাপাচার এর আগে পৃথিবীতে অন্য কোনো জাতির মাঝে ছিল না।

লূত আ. তাদেরকে বারবার এই অপরাধ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পরকালের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, কিন্তু নবীর কোনো কথাই তারা শুনেনি। নিজেদের মতো করে পাপাচারে লিপ্ত ছিল। 

ফলে আল্লাহ তায়ালা লূত আ.-এর জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দিলেন।

শুয়াইব আ.

হজরত মুসা, নূহ, হুদ, সালেহ, ইবরাহিম, লূত আ.-এর উম্মতের আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা সূরার ৮৪-৯৪ আয়াতে হজরত শুয়াইব আ. ও তাঁর উম্মত সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

শুয়াইব আ.-এর উম্মতও শিরক করতো, এর বাইরেও তারা ওজন ও মাপে কম দেওয়া এবং ছিনতাই, ডাকাতি, লুটতরাজে লিপ্ত ছিল। 

শুয়াইব আ. তাদেরকে এই অপরাধ থেকে বিরত থাকার আহ্বান করেন। পাপাচার থেকে না ফিরলে যে, নূহ, হুদ, সালেহ, লূত আ.-এর জাতির মতো তাদের ওপরও আল্লাহর শাস্তি নাজিল হতে পারে সেই ভয় দেখালেন। কিন্তু কোনোভাবে তাদেরকে পাপাচার থেকে ফেরানো গেল না। 

সব চেষ্টা শেষে শুয়াইব আ. ব্যর্থ হয়ে তাদের বললেন,  ঠিক আছে তোমরা নিজের পথে চলতে থাক। অতি সত্ত্বর সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী কে এবং লাঞ্ছনাকর শাস্তির উপযুক্ত কে তা অবশ্যই জানতে পারবে।

তারপর আল্লাহ তায়ালা তার চিরন্তন বিধান অনুসারে শুয়াইব আলাইহিস সালামকে এবং তার সঙ্গী-সাথী ঈমানদারগণকে সেই জনপদ হতে অন্যত্র নিরাপদে সরিয়ে নিলেন এবং জিবরাঈল আলাইহিস সালামের এক ভয়ঙ্কর হাঁকে বাকিদের সবাইকে এক নিমেষে ধ্বংস করে দিলেন। 

(তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা, ৩৫-১১৩)