আল্লাহ তায়ালা হজরত হুদ আ.-কে আদ জাতির কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের তাওহীদের আহ্বান করেন এবং তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করতে নিষেধ করেন। তিনি তাদের বলেন—

তোমরা যাদের পূজা করছো, তাদের তোমরা নিজেরাই বানিয়েছো। এমনকি তাদের নাম ও অস্তিত্বও তোমাদের বাজে কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। 

তিনি তাদেরকে আরও বলেন— আমি তোমাদেরকে যে উপদেশ দিচ্ছি, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। এর প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাকে দান করবেন। তোমরা তোমাদের অতীতের পাপের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকো এবং আগামীতে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকো। এ দুটো গুণ (অতীতের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।) যার মাঝে থাকবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর জীবন-জীবিকার পথ সহজ করে দেবেন এবং তার কাজও সহজ হয়ে যাবে। আর সবসময় তিনি তাঁর হেফাজত করবেন।

জেনে রেখো— তোমরা যদি আমার উপদেশ মতো কাজ করো তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, যে বৃষ্টি তোমাদের জন্য অনেক ‍উপকারী হবে। আর তোমাদের শক্তিকে আল্লাহ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ক্ষমা প্রার্থনাকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নেয় আল্লাহ তায়ালা তার সব কষ্ট ও অসুবিধা ‍দূর করে দেন, সঙ্কীর্ণতা থেকে প্রশস্ততা দান করেন এবং এমন স্থান থেকে তাকে রিজিক দান করেন যা সে কল্পনাও করে না।

হজরত হুদ আ.-এর উপদেশ শুনে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা বললো— 

হে হুদ! তুমি যেদিকে আমাদের আহ্বান করছো তার তো কোনো দলিল আমাদের সামনে পেশ করছো না। আমরা শুধু তোমার কথায় আমাদের উপাস্যগুলোকে পরিত্যাগ করতে পারি না। আমরা তোমাকে সত্যবাদী হিসেবে মানবো না এবং তোমার কথায় ঈমান আনবো না।

তারা বললো, আমাদের মনে হচ্ছে, তুমি যে, আমাদের উপাস্যগুলোকে দোষারোপ করছো, তারা তা সহ্য করতে না পেরে তোমার মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটেয়েছে, ফলে তুমি আমাদের এসব বলে বেড়াচ্ছো।

তাদের এ কথা শুনে হুদ আ. বললেন— তোমাদের ধারণা যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আমি শুধু তোমাদের নয় বরং আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যেসবের ইবাদত করছো, আমি তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ ও মুক্ত। তোমরা চাইলে আমার ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করতে পারো। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার ক্ষতি করার কারো সাধ্য নেই।

আল্লাহ ন্যায় বিচারক, তিনি কখনো অত্যাচার করেন না। বান্দার ঝুটি তাঁর হাতের মুঠের মধ্যে রয়েছে। সন্তানের ওপর পিতামাতার যে দয়া রয়েছে, মুমিন বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া এর থেকে বহুগুণ বেশি। তিনি পরমদাতা, দয়ালু। তাঁর দান ও দয়ার কোনো শেষ নেই।

তিনি আরও বললেন,  আমি আমার কাজ পূর্ণ করেছি। আল্লাহর পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এখন তোমরা তা মান্য না করলে এর শাস্তি তোমাদের ওপর পতিত হবে, আমার ওপর নয়। আল্লাহর এই ক্ষমতা রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জায়গায় এমন জাতিকে আনয়ন করবেন যারা তাঁর তাওহীদকে স্বীকার করে নেবে এবং তাঁরই ইবাদত করবে। তিনি তোমাদের মোটেও পরোয়া করেন না। তোমাদের কুফরি তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বরং শাস্তি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। 

হজরত হুদ আ.-এর সম্প্রদায় তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না। নিজেদের পাপাচারে লিপ্ত থাকলো। ফলে আল্লাহ তায়ালা হুদ আ. ও মুমিনদের ছাড়া তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যদের শাস্তির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিলেন।

পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে—

وَاِلٰی عَادٍ اَخَاہُمۡ ہُوۡدًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرُہٗ ؕ اِنۡ اَنۡتُمۡ اِلَّا مُفۡتَرُوۡنَ ٥۰ یٰقَوۡمِ لَاۤ اَسۡـَٔلُکُمۡ عَلَیۡہِ اَجۡرًا ؕ اِنۡ اَجۡرِیَ اِلَّا عَلَی الَّذِیۡ فَطَرَنِیۡ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ٥١ وَیٰقَوۡمِ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ثُمَّ تُوۡبُوۡۤا اِلَیۡہِ یُرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا وَّیَزِدۡکُمۡ قُوَّۃً اِلٰی قُوَّتِکُمۡ وَلَا تَتَوَلَّوۡا مُجۡرِمِیۡنَ ٥٢ قَالُوۡا یٰہُوۡدُ مَا جِئۡتَنَا بِبَیِّنَۃٍ وَّمَا نَحۡنُ بِتَارِکِیۡۤ اٰلِہَتِنَا عَنۡ قَوۡلِکَ وَمَا نَحۡنُ لَکَ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ٥٣ اِنۡ نَّقُوۡلُ اِلَّا اعۡتَرٰىکَ بَعۡضُ اٰلِہَتِنَا بِسُوۡٓءٍ ؕ  قَالَ اِنِّیۡۤ اُشۡہِدُ اللّٰہَ وَاشۡہَدُوۡۤا اَنِّیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّمَّا تُشۡرِکُوۡنَ ۙ ٥٤ مِنۡ دُوۡنِہٖ فَکِیۡدُوۡنِیۡ جَمِیۡعًا ثُمَّ لَا تُنۡظِرُوۡنِ ٥٥ اِنِّیۡ تَوَکَّلۡتُ عَلَی اللّٰہِ رَبِّیۡ وَرَبِّکُمۡ ؕ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ اِلَّا ہُوَ اٰخِذٌۢ بِنَاصِیَتِہَا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ٥٦ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَقَدۡ اَبۡلَغۡتُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِہٖۤ اِلَیۡکُمۡ ؕ وَیَسۡتَخۡلِفُ رَبِّیۡ قَوۡمًا غَیۡرَکُمۡ ۚ وَلَا تَضُرُّوۡنَہٗ شَیۡئًا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ حَفِیۡظٌ ٥٧ وَلَمَّا جَآءَ اَمۡرُنَا نَجَّیۡنَا ہُوۡدًا وَّالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ بِرَحۡمَۃٍ مِّنَّا ۚ وَنَجَّیۡنٰہُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ غَلِیۡظٍ ٥٨ وَتِلۡکَ عَادٌ ۟ۙ جَحَدُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ وَعَصَوۡا رُسُلَہٗ وَاتَّبَعُوۡۤا اَمۡرَ کُلِّ جَبَّارٍ عَنِیۡدٍ ٥٩ وَاُتۡبِعُوۡا فِیۡ ہٰذِہِ الدُّنۡیَا لَعۡنَۃً وَّیَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ  اَلَاۤ اِنَّ عَادًا کَفَرُوۡا رَبَّہُمۡ ؕ  اَلَا بُعۡدًا لِّعَادٍ قَوۡمِ ہُوۡدٍ ٪ ٦۰ 

আর ‘আদ (সম্প্রদায়) এর প্রতি তাদের ভাই হুদকে (রাসূল রূপে) প্রেরণ করলাম। সে বললঃ হে আমার কাওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া কেহ তোমাদের মা‘বূদ নেই; তোমরা শুধু মিথ্যা উদ্ভাবনকারী। 

হে আমার কাওম! আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাইনা; আমার বিনিময় শুধু তাঁরই জিম্মায় রয়েছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তবুও কি তোমরা বুঝনা?

আর হে আমার কাওম! তোমরা (তোমাদের পাপের জন্য) তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁরই প্রতি নিবিষ্ট হও। তিনি তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদেরকে আরও শক্তি প্রদান করে তোমাদের শক্তিকে বর্ধিত করে দিবেন, আর তোমরা পাপে লিপ্ত হওয়ার জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিওনা। 

তারা বলল, হে হুদ! তুমিতো আমাদের সামনে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করনি এবং আমরা তোমার কথায় আমাদের উপাস্য দেবতাদেরকে বর্জন করতে পারিনা, আর আমরা কিছুতেই তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী নই। আমাদের কথা এই যে, আমাদের উপাস্য দেবতাদের মধ্য থেকে কেউ তোমাকে দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে। 

তিনি বললেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি এবং তোমরাও সাক্ষী থেক যে, আমি তা থেকে মুক্ত, তোমরা যে ইবাদাতে শরীক সাব্যস্ত করছ, তাঁর (আল্লাহর) সাথে। সুতরাং তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাক, অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশ দিওনা।

আমি ভরসা করেছি আল্লাহর উপর যিনি আমার আর তোমাদের রব, এমন কোন জীব নেই যার কতৃত্ব তাঁর হাতে নয়, নিশ্চয়ই আমার রব সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত। 

এরপরও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও (তবে জেনে রেখ), আমাকে যা দিয়ে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে আমি তো তোমাদের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছি, এখন আমার প্রতিপালক তোমাদের স্থলে অন্য সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন আর তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আমার প্রতিপালক সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। 

আমার নির্দেশ যখন এসে গেল, তখন আমি হূদকে আর তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার দয়ায় রক্ষা করলাম, আর তাদেরকে বাঁচিয়ে নিলাম এক কঠিন আযাব থেকে। 

এই হলো আদ জাতি, তারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল, আর তাদের রাসূলদেরকে অমান্য করেছিল, প্রত্যেক প্রবল পরাক্রান্ত, সত্য-দ্বীনের দুশমনের নির্দেশের তারা অনুসরণ করেছিল।

আর এই দুনিয়াতেও অভিসম্পাত তাদের সঙ্গে রইল এবং কিয়ামাত দিবসেও; ভালভাবে জেনে রেখ! আদ জাতি নিজ রবের সাথে কুফরী করল; আরও জেনে রেখ! ধ্বংস করা হয়েছিল আদকে যারা ছিল হূদের সম্প্রদায়। (সূরা হুদ, আয়াত : ৫০-৬০)