আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মহানবী সা. মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান শুরু করলেন। তাঁর আহ্বানকে ব্যাহত করতে সবধরনের চেষ্টা চালালো মক্কার কাফের ও কুরাইশ নেতারা। মুসলমানদের নির্যাতন, ভয়ভীতি কোনো প্রচেষ্টাই বাকি রাখেনি তারা। এসবে যখন কোনো কাজ হলো না, মক্কার লোকজন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো, তখন তারা ভিন্ন পথ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিলেন। 

হেদায়েতের নূর থেকে দূরে সরে থাকা কাফেররা ভেবেছিল আল্লাহর রাসূল সা. হয়তো পার্থিব কোনো যশখ্যাতি বা লাভের আশায় মানুষকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করছেন, তাই তারা এবার নির্যাতনের পথ ছেড়ে প্রলোভনের পদ্ধতি অবলম্বন করলেন।

আবু জাহেল, উতবা,শায়বা, ওলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালফ, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিবসহ কুরাইশের শীর্ষনেতারা মিলে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো— এবার তারা রাসূল সা.-কে পার্থিব বিভিন্ন প্রলোভন দেখাবেন। এজন্য জাদুবিদ্যা, কাহিনীকার ও কবিতা চর্চায় পারদর্শী উতবা ইবনে রবীয়াকে নির্বাচন করলেন তারা।

উতবা ইবনে রবীয়া রাসূল সা.-এর কাছে এসে বললৈন— মুহাম্মদ! তোমার বংশ মর্যাদা, যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই আমাদের, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তুমি পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছো। তুমি আমাদের প্রতিমাগুলোকে মন্দ বলছো, আমাদের বাপ-দাদাদের বোকা ও মূর্খ বলছো, আমি তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাইছি।

 

রাসূল সা. বললেন, বলুন হে আবুল ওলীদ, আমি শুনছি।

উতবা বললেন—

হে আমার ভাতিজা! তোমার এসব কথা (ইসলামের প্রতি আহ্বান) মূল উদ্দেশ্য কী? তুমি যদি ধন-সম্পদের প্রত্যাশী হও তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে এতো পরিমাণ সম্পদ একত্র করে দেবো যে, তোমার মতো সম্পদশালী আর কেউ হবে না। আর তুমি যদি বিয়ে করতে চাও তাহলে যে মেয়েকে ইচ্ছা, যতজনকে ইচ্ছা বিয়ে করতে পারো। আর যদি সম্মান ও নেতৃত্ব লাভের ইচ্ছায় এসব করে থাকো তাহলে বলো আমরা সবাই মিলে তোমাকে আমাদের নেতা হিসেবে মেনে নেবো। আর যদি তুমি বাদশাহী চাও, তা বলো, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের বাদশা হিসেবে মেনে নিবো। আর যদি অসুস্থ হয়ে থাকো, আমাদরে জানাও, আমরা তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।

রাসূল সা. বললেন, হে আবুল ওয়ীদ! আপনার যা বলার ছিল আপনি কি তা শেষ করেছেন?

উতবা বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল সা. বললেন, এবার আমি যা বলছি তা শুনুন—

আপনাদের ধন-সম্পদের প্রয়োজন আমার নেই, আর আপনাদের নেতৃত্ব সর্দারি করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি তো আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আমাকে আপনাদের প্রতি পয়গম্বর হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তিনি আমার প্রতি একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তিনি আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি আপনাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ শোনাব এবং তাঁর আজাবের ভীতি প্রদর্শন করবো। আমি আপনাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি। আপনাদের কল্যাণকামী হিসেবে উপদেশ আকারে তা অবহিত করেছি। যদি আপনারা তা গ্রহণ করেন তাহলে তা আপনাদের উভয় জগতের সৌভাগ্য ও কল্যাণের কারণ হবে। আর যদি না মানেন তাহলে আল্লাহ আমার এবং আপনাদের মাঝে ফয়সালা না করা পর্যন্ত আমি সবর করবো। এরপর তিনি পবিত্র কোরআনে সূরা হা-মীম-আস-সাজদার ১-১৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন।

নবীজির তিলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন উতবা। এ সময় তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করো। এ সময় উতবার ভয় হচ্ছিল না জানি আদ ও সামূদ সম্প্রদায়ের মতো এখনই তার ওপর আজাব নাজিল হয়ে যায়!

তিলাওয়াত শেষে রাসূল সা. বললেন, হে আবুল ওলীদ! যা শোনার ছিল আপনি শুনেছেন, এখন আপনার ইচ্ছা। 

উতবা রাসূল সা.-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। কিন্তু তিনি আর সেই আগের উতবা ছিলেন না। তাকে দেখে আবু জাহেল বলে উঠলো— আরে, এতো সেই আগের উতবা নেই, উতবা তো ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে। 

উতবা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললেন—

আমি তাঁর কথা শুনেছি, আল্লাহর কসম আমি এর আগে আর কোনোদিন এমন কথা শুনিনি। তা না কবিতা, না জাদু আর না কাহিনী, এতো অন্য কিছু। যদি তোমরা আমার কথা শোন, তাহলে মুহাম্মদকে তাঁর অবস্থায় ছেড়ে দাও। আল্লাহর শপথ, যে বাণী আমি তাঁর থেকে শুনে এলাম, অচিরেই তার বিশেষ মর্যাদা অর্জিত হবে। আরববাসী যদি তাঁকে ধ্বংস করে দেয়, তবে তো তোমাদের চিন্তুার কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি মুহাম্মদ আরববাসীর ওপর বিজয়ী হয়, তাহলে তো তা তোমাদের সম্মান, তাঁর নেতৃত্ব তো তোমাদেরই নেতৃত্ব, কারণ, সে তো তোমাদেরই সম্প্রদায়ের লোক। কুরাইশরা বললো, হে আবুল ওলীদ! মুহাম্মদ তোমাকে জাদু করেছে।

উতবা বললো, আমার যা বলার বলেছি, এখন তোমাদের যা ইচ্ছা করো।

(সীরাতুল মুস্তাফা সা. ১/ ১৬৬)