মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নবুয়ত নাজিলের পর প্রথমে তিনি গোপনে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করতেন। এরপর নিজের আত্মীয়-স্বজনদের ইসলামের দাওয়ার দিয়েছেন। তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে তাকে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই নির্দেশের পর একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার সাফা পর্বতের চূড়ায় উঠলেন। তৎকালীন সময়ে কেউ গোত্র বা জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাইলে কোনো উঁচু জায়গা বা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সবাইকে তার দিকে আকষর্ণ করতেন এরপর তা বলতেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সেই রীতি অনুসারে সাফা পর্বতে উঠে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি সাফা পর্বতের শিখরে আরোহন করে কুরাইশ গোত্রের সবাইকে লক্ষ্য করে বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে থাকলেন—

‏‏يَا بَنِيْ فِهْرٍ، يَا بِنْيِ عَدِىٍّ، (يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ مَنَافٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ‏)

হে বনু ফিহর! ওহে বনু আদী! (ওহে বনু অমুক, ওহে বনু ওমুক, ওহে বনু আবদে মানাফ, ওহে বনু আবদুল মুত্তালিব)

এ আহ্বান শুনে সবাই সেখানে সমবেত হলেন। কোনো ব্যক্তির পক্ষে সেখানে উপস্থিতি সম্ভব না হলে ব্যাপারটি জানার জন্য তিনি সেখানে প্রতিনিধি পাঠালেন। এভাবে কুরাইশ গোত্রের সবাই সেখানে উপস্থিত হলেন। আবু লাহাবও উপস্থিত হলো।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—

‏(‏أَرَأَيْتُكُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خَيْلًا بِالْوَادِىِّ بِسَفْح هٰذَا الْجَبَلِ تُرِيْدُ أَنْ تَغَيَّرَ عَلَيْكُمْ أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِىَّ‏؟‏‏)

হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা বল, আজ (এ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে) যদি আমি তোমাদেরকে বলি যে, পাহাড়ের ওপর দিকে এক দুর্ধর্ষ শত্রু বাহিনী তোমাদের অপেক্ষা করছে, সুযোগ বুঝে তারা তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে এবং তোমাদের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাবে তাহলে কি তোমরা আমার এ কথা বিশ্বাস করবে?

সবাই সমস্বরে উত্তর করল হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বিশ্বাস না করার কোনই কারণ নেই। আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যার সংস্পর্শে আসতে দেখি নি।

তাদের এ জবাবের পর রাসূল সা. গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন—

‏(‏إِنِّىْ نَذِيْرٌ لَّكُمْ بَيْنَ يَدْى عَذَابٍ شَدِيْدٍ، إِنَّمَا مَثَلِىْ وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ رَأَي الْعَدُوَّ فَانْطَلَقَ يَرْبَأ أَهْلَهُ‏) ‏‏(‏ أَيْ يَتَطَلِّعُ وَيُنْظَرُ لَهُمْ مِنْ مَكَانٍ مُّرْتَفِعٍ لِئَلاَّ يُدْهِمُهُمْ الْعَدُوُّ‏)‏ ‏(‏خَشِىَ أَنْ يَسْبِقُوْهُ فَجَعَلَ يُنَادِىْ‏:‏ يَا صَبَاحَاه‏)

যদি তাই হয় তাহলে আমি আপনাদেরকে (পাপ ও আল্লাহ দ্রোহিতার ভীষণ পরিণাম ও এ কারণে) অবশ্যম্ভাবী কঠোর শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি ....।

এরপর তিনি সাধারণ ও বিশেষভাবে সবাইকে সত্যের পথে আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বললেন—

‘হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর এবং তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সঁপে দিয়ে তার সন্তুষ্টি অর্জন করো।’

‘হে বনু কাব বিন লুহাই, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। কেননা আমি তোমাদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।’

‘হে বনু কাব বিন মুররাহ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।’

‘হে বনু কুসাই সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।’

‘হে বনু আবদে মানাফ সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। কারণ, আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোনো উপকারে আসবো না ।’

‘হে বনু আবদে শামস, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’

‘হে বনু হাশিম, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।’

‘হে বনু আব্দুল মুত্তালিব সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কোনো উপকারে আসবো না। আমার কাছ থেকে তোমরা ইচ্ছমতো কোন সম্পদ চেয়ে পার কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোনো উপকারে আসবো না।’

‘হে বনু আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কোনো উপকারে আসবো না।’

‘হে সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাসূলুল্লাহ সা,-এর ফুফু), আমি আপনার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো উপকারে আসবো না।‘

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ভীতিপ্রদর্শনমূলক বক্তব্য শেষে লোকজন যার যার মতো চলে গেল, কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। কিন্তু আবু লাহাব রাসূল সা.-এর কাছে এসে বলে উঠলেন, ‘তোর সর্বনাশ হোক! এ জন্য কি তুই এখানে আমাদেরকে সমবেত করেছিস? 

এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের সূরা লাহাব অবতীর্ণ করলেন। যেখানে বলা হয়েছে—

‏(‏تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَتَبَّ‏)‏ 

আবু লাহাবের হাত ধ্বংস হোক।’ (সূরা লাহাব. আয়াত : ১)

এভাবে পর্বতের চূড়ায় উঠে সবাইকে আহ্বান করে ইসলামের বাণী শোনানোর উদ্দেশ্য ছিল দীনের দাওয়াতের বাণী পৌছে দেয়া। এর মাধ্যমে রাসূল সা. তার কাছের লোকেদের মাঝে এটা পরিস্কার করলেন যে, তাঁর রেসালাতকে সত্যায়ন করার অর্থই হলো, রাসূল সা. এবং তাদের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ণ জীবনের সূত্রপাত কারণ। আর আরবে যে আত্মীয় সম্বন্ধের যে মজবুত ভিত্তি রয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সতর্কবাণীর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।

(সহিহুল বুখারী ২/৭০২-৭৪৩, সহিহুল মুসলিম ১/১১৪, আর রাহীকুল মাখতুম)