মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবিদের একজন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আস রা.। তার বাবা ছিলেন প্রখ্যাত সেনানায়ক ও কূটনীতিবিদ হজরত আমর ইবনুল আস রা.। মা ছিলেন রীতা বিনতু মানাববিহ। 

রাসূল সা.-এর দেওয়া নাম

ইসলাম পূর্ব সময়ে তার নাম আল-আস (পাপী, অবাধ্য) ছিল। একদিন এক জানাজার অনুষ্ঠানে রাসূল সা. তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি আল-আস জানালে রাসূল সা. তা পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ রেখে বললেন, আজ থেকে তোমার নাম আব্দুল্লাহ। তিনি তাঁর বাবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। 

রাসূল সা. সব কথা লিখতেন তিনি...

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তিনি বেশিরভাগ সময় রাসূল সা.-এর সংস্পর্শে কাটাতেন। রাগ অথবা স্বাভাবিক সময়— যেকোনো মুহূর্তেই রাসূল সা.-এর মুখ থেকে কোনো কথা বের হলে তিনি তা লিখে রাখতেন। কোনো কোনো সাহাবি তাঁকে এমন না করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন, উত্তেজিত অবস্থায় রাসূল সা.-এর মুখ থেকে যা বের হয় তা না লেখা উচিত। তিনি বিষয়টি রাসূল সা.-কে জানালেন। আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, তুমি আমার সব কথা লিখতে পারো। সত্য ছাড়া অন্য কিছুই আমি বলতে পারি না।

সারাদিন রোজা

রাসূল সা. সাহচর্যের বাইরে দিনের যেই সময়টুকু পেতেন তা তিনি রোজা রেখে ও ইবাদত করে কাটাতেন। ধীরে ধীরে তিনি এতোটাই ইবাদতে অভ্যস্ত হলেন যে, স্ত্রী-পরিজন, দুনিয়া সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়লেন। একদিন তার বাবা রাসূল সা.-এর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেন। তখন রাসূল সা. তাঁকে ডেকে বাবার অনুগ্রত্যের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তুমি রোজা রাখো, ইফতার করো, নামাজ পড়ো, বিশ্রাম নাও, স্ত্রী-পরিজনের হক আদায় করো, এটাই আমার তরীকা বা পন্থা। যে আমার তরীকা প্রত্যাখ্যান করবে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।

সাওমে দাউদ...

আরেক বর্ণনায় আছে, একবার রাসূল সা.-তাঁকে ডেকে বললেন, আব্দুল্লাহ আমি জানতে পেরেছি, তুমি সারা জীবন রোজা রেখে ও সারা রাত ইবাদত করে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছো? তিনি বললে, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ।

রাসূল সা. বললেন, তোমার সে শক্তি নেই। মাসে শুধু তিন দিন রোজা রাখো। তিনি বললেন, আমি এর থেকেও বেশি শক্তি রাখি। রাসূল সা. বললেন, একদিন রোজা রাখবে এবং দুইদিন ইফতার করবে। তিনি বললেন, আমি এর থেকেও বেশি শক্তি রাখি। রাসূল সা. বললেন, একদিন রোজা রাখবে এবং একদিন ইফতার করবে। এটাই দাউদ আ.-এর সুন্নত। এটাই রোজার সর্বোত্তম পদ্ধতি। তিনি বললেন, আমি এর থেকেও উত্তম রোজা রাখতে পারি। রাসূল সা. বললেন, এর থেকে উত্তম রোজা নেই।  

কোরআন তিলাওয়াত

কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি প্রচুর আগ্রহ ছিল তার। এতো বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন যে, প্রতি তিনদিনে একবার খতম করতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এতো বেশি ইবাদত তাঁর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। তখন মাঝে মাঝে আফসোস করে বলেন, হায়! আমি যদি রাসূল সা.-এর প্রদত্ত রুখসত বা কম (ইবাদত) করার অনুমতি গ্রহণ করতাম। 

রাসূল সা.-এর যুগে সংঘটিত সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধের সময় সওয়ারী, পশুর ব্যবস্থা ও জিনিপত্র পরিবহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হতো।

সাহাবিদের মাঝে বিশেষ মর্যাদা 

জ্ঞান ও মান-মর্যাদার দিক দিয়ে সাহাবিদের সমাজে তার বিশেষ অবস্থান ছিল। মাতৃভাষা আরবি ছাড়াও হিব্রু ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। তাওরাত ও ইনজিল গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি বলেন, আমি একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমার এক হাতে মধু, অন্য হাতে চর্বি, আমি তা চেটে চেটে খাচ্ছি। স্বপ্নের একথা আমি রাসূল সা.-কে জানালাম। তিনি বললেন, তুমি তাওরাত, কোরআন এই দুটি গ্রন্থ পাঠ করবে। (আল-ইসাবা)।

হাদিসের বিশাল ভাণ্ডার

হাদিসে নববীর বিশাল ভাণ্ডার জমা ছিল তার কাছে। এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমার থেকেও আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের বেশি হাদিস মুখস্ত ছিল। কারণ, তিনি রাসূল সা.-এর কাছ থেকে যা শুনতেন তাই লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না। (তাজকিরাতুল হুফফাজ, আল-ইসাবা)।

‘সাদেকা’

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. রাসূল সা. মুখনিঃসৃত বাণীর বিরাট একটি অংশ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তাঁর সংগ্রহটির নাম রেখেছিলেন ‘সাদেকা’। তাঁর কাছে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সে সম্পর্কে তাঁর স্মুতিতে কিছু না থাকলে ‘সাদেকা’ দেখে উত্তর দিতেন। 

বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা 

তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৭০০। এরমধ্যে ১৭টি মুত্তাফাক আলাইহি, আটটি বুখারি এবং ২০টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। (তাহজীব)।

তার দরসে হাদিসের সীমা ছিল সুপ্রশস্ত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ হাদিস শোনার জন্য তাঁর কাছে আসতো। তিনি যেখানেই যেতেন, জ্ঞান পিপাসুদের বিশাল সমাবেশ ঘটতো তাঁর পাশে।

তিনি ৬৫ হিজরিতে মিসরের ফুসতাত নগরে ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

(আসহাবে রাসূলে জীবনকথা, ২/ ৪৩-৪৭)