বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের শৈশব-বেড়ে ওঠার দিনগুলো কেটেছে দুধ মা হালিমার কাছে। তৎকালীন আরবের রীতি অনুযায়ী শহরের অভিজাত পরিবারের শিশুদের দুধ পানের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হতো যেন তারা বিশুদ্ধ আবহাওয়ায় বেড়ে উঠতে পারে।

প্রতি বছর মক্কায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে আশপাশের বিভিন্ন গোত্র থেকে ধাত্রীরা আসতেন। মুহাম্মদ সা.-এর জন্মের বছর বনু সাদ গোত্র থেকে স্বামী, দুগ্ধপোষ্য ছেলেকে নিয়ে একদল মহিলার সঙ্গে দুধ শিশুর সন্ধানে মক্কায় গেলেন হালিমা সাদিয়া রা.। 

মক্কায় হালিমা সাদিয়া

হালিমা সাদিয়া রা. এ বিষয়ে নিজেই বলেছেন—

এ বছরটি ছিল দুর্ভিক্ষের। দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা সবাই নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। এই দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির জন্য আমরা বৃষ্টির অপেক্ষা করছিলাম।

আমি একটি গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। সঙ্গে একটি বয়স্ক উটও। কিন্তু উটের ওলানে কোনো দুধ ছিল না। আমার স্তনেও দুধ ছিল না। তাই আমার দুধের শিশুটি ক্ষুধার জ্বালায় এতো কান্না করছিল যে, এ কারণে আমাদের পুরো রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছিল।  আমাদের গাধাটিও চলছিল ধীরগতিতে। কাফেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলাম না আমরা। এভাবেই এক সময় মক্কায় পৌঁছে দুধ শিশু খুঁজতে লাগলাম। 

দুধ শিশুর সন্ধান

আমাদের কাফেলার সবাইকে শিশু মুহাম্মদকে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো, কিন্তু এতিম শিশু হওয়ায় কেউ আগ্রহ দেখালো না তাঁকে নিতে। সব ধাত্রীই শিশুর বাবার কাছ থেকে ভালো উপঢৌকন আশা করছিল। তাই সবার ধারণা ছিল, পিতৃহীন এই শিশুর মা, দাদা তেমন কোনো উপঢৌকন দিতে পারবে না। তাই সবাই শিশু মুহাম্মদকে এড়িয়ে যাচ্ছিল।

স্বামীর সঙ্গে হালিমার পরামর্শ

এদিকে আমার সঙ্গে আসা ধাত্রীদের সবাই নিজের পছন্দমতো দুধ শিশু পেয়ে গেল। কিন্তু আমি কোনো শিশু পেলাম না। খালি হাতেই বাড়িতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। হঠাৎ, আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলে আমার স্বামীকে বললাম, সহযাত্রীদের সঙ্গে একেবারে খালি হাতে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগছে। একেবারে শূন্য হাতে ফিরে যাবার থেকে ওই এতিম শিশুটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।

আমার স্বামী বললেন, কোনো আপত্তি নেই। নিতে পারো। বলা যায় না, আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাঝে হয়তো কল্যাণ রেখেছেন। 

হালিমা বলেন, অন্য কোনো শিশু না পাওয়ার কারণে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শিশু মুহাম্মদকে কোলে নিলাম। এরপর থেকেই শুরু হলো বরকত।

বরকতের সূচনা যেভাবে...

হালিমা সাদিয়া রা.-এর বর্ণনায়, শিশু মুহা্ম্মদকে কোলে নেওয়ার পর আমার স্তন দুধে ভরে উঠলো। সে নিজে পেটভরে পান করলো। তার দুধভাই—আমার নিজের কোলের শিশুটিও দুধ পান করে তৃপ্ত হলো। এরপর তারা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ মক্কায় আসার পথে আমাদের এই সন্তানের ক্ষুধা নিবারণ করতে না পারার কারণে আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।

মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে হালিমার স্বামীর মন্তব্য

আমার স্বামী উটের কাছে যেতেই দেখতে পেলেন, তার ওলানো দুধে টইটম্বুর। আমরা তৃপ্তি ভরে দুধ দোহন করে খেলাম। ভালোভাবেই কেটে গেলো আমাদের সে রাত।  সকালবেলা আমার স্বামী বললেন, হালিমা, আমার মন বলছে, তুমি বড়ো বরকতময় এক শিশু নিয়ে এসেছো।

এরপর যখন আমরা নিজেদের গোত্রের উদ্দেশে রওয়া দিলাম, তখন আমাদের গাধাটি লাফিয়ে লাফিয়ে সবার আগে চলছিল। অথচ মক্কায় যাওয়ার পথে এই গাধাটি এতোটাই দুর্বল ছিল যে, আমরা কাফেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলাম না।

আমাদের গাধাটির এমন সতেজ গতি দেখে কাফেলার অন্যরা অবাক হয়ে গেল।

হালিমার জীবনে সৌভাগ্যের ছোঁয়া

আমাদের এলাকায় দুর্ভিক্ষ-খরা চলছিল। অথচ শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে ফেরার পর মনে হলো এখানে কোনো খরা ছিল না। চারণভূমি ঘাস,তরুলতায় পূর্ণ হয়ে গেল। আমাদের পশুগুলো প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভরপেট-ওলান ভর্তি করে ঘরে ফিরতো। অথচ অন্যদের ছাগল-ভেড়ার ওলান থেকে একফোঁটা দুধও বের হতো না। এ অবস্থা দেখে, লোকজন তাদের রাখালকে বলতে লাগলো, আরে, বোকার দল! হালিমার রাখাল যে মাঠে পশু চরায় সেখানে তোমরাও পশু নিয়ে যাও।

শিশু মুহাম্মদকে নেওয়ার পর থেকে এভাবেই একের পর এক সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠছিল আমাদের পরিবার।

(সীরাতুন-নবী সা. ১/১৫৮)