প্রতীকী ছবি

হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পায়ের আঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল জমজম কূপ। পরবর্তীতে মক্কায় বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায় কূপটি নিয়ন্ত্রণ করে। জুরহুম নামে একটি গোত্র মক্কা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পায়। 

এ সময় খুজাআ নামক একটি গোত্র মক্কায় আক্রমণ করে। আক্রমণের সময় জুরহুম গোত্র মক্কা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালিয়ে যাওয়ার আগে তারা জমজম কূপের মুখ ঢেকে দিয়ে যায়, (যাতে খুজাআ গোত্র মক্কায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস ও পানি পান করতে না পারে) এবং কাবার ভেতর রক্ষিত সব সোনাদানা লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়।

এরপর সংস্কারের অভাবে একসময় জমজম কূপের স্থান মাটিতে ভরাট হয়ে যায়। এভাবেই কালের আবর্তে এক সময় কূপটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। মানুষ কূপটির কথা ভুলে যায়। কূপটি খনন করে পুনরুদ্ধার করেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাদা আব্দুল মুত্তালিব।

আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের গোত্র প্রধান। তাকে সবাই সম্মান-শ্রদ্ধা করতো। তিনি সবার বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতেন। আব্দুল মুত্তালিব একবার স্বপ্নে দেখলেন, তাকে জমজম কূপ খনন করতে বলা হচ্ছে এবং স্বপ্নেই তাকে কূপের জায়গাটি নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঘুম ভাঙার পর আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নের বিষয়টি কয়েকবার ভাবেন। এরপর নিজের বড় ছেলে হারিসকে নিয়ে স্বপ্নের দেখানো জায়গায় জমজম কূপ খননের কাজ শুরু করেন।

জমজম কূপ খননের সময় এখান থেকে তিনি কিছু তলোয়ার, লৌহবর্ম ও দুইটি সোনার হরিণ পেয়েছিলেন। আব্দুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দিয়ে কাবা ঘরের দরজা ঢালাই করেন, সোনার হরিণ দুটি দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন।

খনন কাজ করতে করতে এক সময় আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ফেললেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি! মক্কাবাসী দেখ, আমি জমজম কূপ খুঁজে পেয়েছি!

আব্দুল মুত্তালিবকে ঘিরে ধরল মক্কার বিভিন্ন গোত্র। বলল— আব্দুল মুত্তালিব! এটা আমাদের পূর্বপুরুষ ইসমাইল আ.-এর কূপ। কাজেই আমরা সবাই এটার অংশীদার।

তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আব্দুল মুত্তালিব বেঁকে বসলেন। বললেন— না, এই কূপ আল্লাহ আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন। আমি তোমাদের সবাইকে পানি দেব, কিন্তু এর মালিকানা আমার থাকবে।

বাকিরা কিছুইতে আব্দুল মুত্তালিবের কথা মানতে রাজি হলো না। এনিয়ে অনেক মনোমালিন্য ও তর্কবির্তক হলো। বিষয়টির সমাধানে আব্দুল মুত্তালিব বললেন – শোনো! চলো আমরা সবাই মিলে একজন জ্ঞানী মানুষের কাছে যাই যিনি আমাদের এই ঝগড়ার সুরাহা করে দেবেন।

সবাই পরামর্শক্রমে বনু সাদ গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি অনেক দূরে থাকতেন। সবাই মিলে তার কাছে রওয়ানা হলেন। তার কাছে যাওয়ার সময় মরুভূমিতে কাফেলার কাছে থাকা সব পানি শেষ হয়ে গেল। কারো কাছে খাওয়ার মতো কোনো পানি অবশিষ্ট থাকলো না। নির্জন মরুপ্রান্তরে পানি ছাড়া জীবন বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। এদিকে অনেক খোঁজাখোঁজি করেও পানির কোনো হদিস মিললো না। 

মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে কাফেলার সবাই মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগলো। মৃত্যুর পর প্রাণী-পাখিদের কবল থেকে লাশ রক্ষা করতে সবাই নিজের জন্য কবর খুঁড়ে রাখলো, যেন কেউ মারা গেলে অন্তত অন্যরা দাফন করতে পারে।

এই কঠিন মুহুর্তে হাল ছাড়লেন না আব্দুল মুত্তালিব। এই সময় তিনি বলে উঠলেন – আল্লাহর কসম! এভাবে মৃত্যুর কাছে হার মানার কোনো মানে হয় না। হয়তো বা আল্লাহ আমাদের জন্য অন্য কোথাও পানি রেখেছেন, চলো আমরা আবার চলা শুরু করি!

এই বলে যেই মাত্র আব্দুল মুত্তালিব তার উটের পিঠে চড়েছেন, উট তখন ঝটকা মেরে মাটিতে খুর দিয়ে আঘাত করল– আল্লাহর কুদরতে ফিনকি দিয়ে বালুর ভেতর থেকে পানি বের হওয়া শুরু হলো।

সবাই বলে উঠলো—ওটা কি আব্দুল মুত্তালিব! ওটা কী? তুমি আরেকবার আরেকটা কূপের সন্ধান পেয়ে গেছ!

সবাই যেন নিজের জীবন ফিরে পেল! প্রাণ ভরে পানি পান করে পানির পাত্রগুলো ভরে নিলো।

এ ঘটনার পর কুরাইশবাসীর মন পাল্টে গেল। তারা ভাবল এটা নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ইশারা, তাই তো এই নির্জন মরুভূমিতে আবারো পানির সন্ধান পেলেন আব্দুল মুত্তালিব। তাই জমজমের দায়িত্ব আব্দুল মুত্তালিবকেই দেওয়া যুক্তিযুক্ত।

তখন তারা সমস্বরে বলে উঠল—যে আল্লাহ তোমাকে মরুভূমিতে এই পানির সন্ধান দিয়েছেন, তিনিই তোমাকে জমজম দিয়েছেন।

এরপর তারা সমাধানের জন্য সেই ব্যক্তি কাছে না গিয়ে মক্কায় ফিরে গেল এবং জমজমের মালিকানা আব্দুল মুত্তালিবকে ছেড়ে দিল।

(সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, ১৪২-১৪৭)