হজ ফরজ হওয়ার আগে এবং পূর্ব যুগ ও ইসলামের শুরুর বছরগুলোতেও মানুষেরা মক্কায় এসে হজ পালন করতো তাদের নিজস্ব নিয়মে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা নবুওয়ত দেওয়ার পর তিনি হজ মৌসুমকে ইসলামের প্রচার-প্রসারে কাজে লাগাতেন। এ সময় মক্কায় আগতদের মাঝে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

হজের জন্য মক্কায় বিভিন্ন গোত্রের আগমন

তখনকার দিনে হজ মৌসুমে মক্কার আশপাশ ও দূরবর্তী এলাকা থেকে মানুষেরা পায়ে হেঁটে, সওয়ারিতে করে হজ পালন করতে আসতো। মহানবী সা. তাদের সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে বলতেন।

নবুওয়তের চতুর্থ বছর থেকে হিজরতের আগ পর্যন্ত মোট ১০ বছর তিনি প্রতি হজ মৌসুমে এভাবেই মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করতেন। এ সময় আহ্বান জানানো কোনো গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি।

হজ মৌসুমে যেসব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন মহানবী সা.

ইমাম যুহরী বলেন, রাসূল সা. যেসব গোত্রের কাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন তারা হচ্ছে— বনু আমের ইবনে সায়া’সায়া, মোহারেব ইবনে খাছবা, ফাজারাহ, নাসসান, মায়রা, হানিফা, ছালিম, আবাস, বনু নছর, বনু আলবাকা, কেলাব, হারেছ ইবনে কা’ব আযারাহ ও হাযারেম।

ইবনে ইসহাক কয়েকটি গোত্রের কাছে নবীজির ইসলামের দাওয়াত প্রদান ও তাদের জবাবের প্রকৃতি উল্লেখ করেছেন। এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—

বনু কেলাব

রাসূল সা. এই গোত্রের একটি শাখা বনু আব্দুল্লাহর কাছে গিয়ে তাদের ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান আনার আহ্বান জানান। তিনি তাদের বলেছিলেন, হে বনু কেলাব! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পিতামহকে কত সুন্দর না দিয়েছেন।

কিন্তু রাসূল সা.-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি বনু কেলাব।

বনু হানিফা

রাসূল সা. এই গোত্রের লোকদের বাড়িতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা জবাবে যা বলেছিল, আরবের অন্য কোনো গোত্র এমন জবাব দেয়নি।

আমের ইবনে সায়া’সায়া

রাসূল সা. হজ মৌসুমে এই গোত্রকেও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। জবাবে এ গোত্রের বুহায়রাহ বিন ফারাস নামক এক ব্যক্তি বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ, যদি আমি কুরাইশের এক যুবককে সঙ্গে রাখি, তবে সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলবো। 

এরপর সে বললো, একটা কথার জবাব দিন, যদি আমি আপনার দ্বীন গ্রহণ করি এবং এরপর আপনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন, এরপর কি নেতৃত্ব আমাদের হাতে আসবে?

রাসূল সা. বলেছিলেন, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব তো আল্লাহর হাতে, তিনি যেখানে ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা দেবেন।

এরপর সেই লোক বললো, চমৎকার কথা। আপনার নিরাপত্তার জন্য আমরা নিজেদের বুককে আরবদের নিশানা করবো অথচ আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব থাকবে অন্যদের হাতে এটা হয় না। আপনার দ্বীন আমাদের প্রয়োজন নেই।

হজ মৌসুম শেষে বনু আমের গোত্র তাদের এলাকায় ফিরে গেল। তাদের এলাকার এক বৃদ্ধ এই ঘটনা শুনলেন। যিনি বার্ধক্যের কারণে হজে যেতে পারেননি। 

সব শোনার পর তিনি দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন, তুমি মারাত্মক ভুল করেছো। হে আবু আমের গোত্রের লোকেরা, সেই লোককে কি খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায় আছে? 

‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, হজরত ইসমাঈলের কোনো বংশধরই নবুওয়তের মিথ্যা দাবি করতে পারে না, অতীতেও করেনি। তোমাদের বুদ্ধি চলে গিয়েছিল?

আবু লাহাবের বিরোধিতা

রাসূলুল্লাহ সা. হজ মৌসুমে যখনই কোনো গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতেন, তখনই আবু লাহাব সেখানে উপস্থিত হতো। ইসলামের বিরোধিতা করতো, আল্লাহর রাসূলকে অপমান করে লোকজনকে ইসলাম থেকে বিরত রাখতো এবং বলত—

‘হে অমুক গোত্র! সে তোমাদের আহ্বান করছে তোমরা লাত ও উজ্জার পূজা ও বিশ্বস্ততার শিকল নিজেদের গলা থেকে ছুড়ে ফেলো এবং নিজেদের সাহায্যকারী জিনদের সঙ্গেও সম্পর্ক ত্যাগ করে সেই বিদআত ও বিভ্রান্তি গ্রহণ করো, যা সে নিয়ে এসেছে। অতএব, তোমরা তাঁর কথা মানবে না, তাঁর কথা শুনবে না।’ 

(আর রাহীকুল মাখতুম, ১৪৭, তিরমিজি, মুখতাছারুর সীরাত, ১৪৯, রহমাতুললিল আলামিন, ১/৭৪, ইবনে হিশাম, ১/৪৪৩-৪৪৮, নবীয়ে রহমত, ১৫৭)