বদর দিবস আমাদের যা কিছু শেখায়
আজ ১৭ রমজান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের ১৭ রমজান। ওই দিন মাত্র ৩১৩ জন সাহাবিকে নিয়ে বিশ্বনবী (সা.) মদিনা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বদর নামক স্থানে কাফিরদের প্রতিরোধ করেন। রক্ষক্ষয়ী এ যুদ্ধকে ইসলামের ইতিহাসে ‘বদর যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়।
পবিত্র রমজান মাস ইসলাম ও মুসলিমদের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বুকে ধারণ করে আছে। সেগুলো বিশেষভাবে মুসলমানদের ত্যাগ, বিজয় ও সফলতার ইতিহাসসমৃদ্ধ। ড. ওহাবা জুহাইলি (রহ.) তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু’র মধ্যে মাহে রমজানের বৈপ্লবিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, যুগে যুগে মুসলমানরা কীভাবে রমজান উদযাপন করেছেন।
বিজ্ঞাপন
অন্যায়ের সঙ্গে আপস নয়
স্বভাবতই মুসলমানরা শান্তভাবে সিয়াম সাধনা করে। অনাহুত ও বিবেক-বর্জিত কাজ থেকে দূরে থেকে তারা রোজা রাখে। তবে কেউ অন্যায় করলে তাকে প্রশ্রয় দেয় না। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ।
মক্কার অদূরে বদর নামক স্থানে এ মাসেই সংঘটিত হয়েছিল ঈমান ও কুফরের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান এ প্রান্তরেই সংঘটিত হয়েছিল মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যকার এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন প্রায় নিরস্ত্র মুসলমানের মোকাবেলায় শোচনীয় পরাজয় বরণ করে কাফির বাহিনীর সহস্রাধিক সশস্ত্র সৈন্য। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওই দিন সরাসরি তিন থেকে পাঁচ হাজার ফেরেশতা দিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করা হয়।
মহাবিপ্লব ও ক্ষমাসুলভ আচরণ
যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মহাবিপ্লব সাধিত হয়েছে। তাই পবিত্র কোরআনে এ যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বদর যুদ্ধে আবু জাহেল, উতবা, শায়বাসহ মোট ৭০ জন কাফির নিহত হয়। আরো ৭০ জন কাফির মুজাহিদদের হাতে বন্দি হয়।
অন্যদিকে ১৪ জন মুসলিম মুজাহিদ বীরবিক্রমে লড়াই করে শাহাদাতের গৌরব অর্জন করেন। বন্দিদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর ক্ষমাসুলভ আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
রমজানে আরও যত ঘটনা
এছাড়াও আরও বহু ঘটনা আছে, যেগুলো রমজানের বৈপ্লবিক দিক স্পষ্ট করে তোলে। যেমন— অষ্টম হিজরির ২০ বা ২১ রমজান জুমাবার রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কা বিজয় করেন। অষ্টম হিজরির ২৫ রমজান মহানবী (সা.) হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন নাখলা নামক জায়গার একটি বৃহদাকার মূর্তি অপসারণের জন্য, কাফিররা এর পূজা করত—যার নাম ছিল উজ্জা। হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) নিজ হাতে ওই মূর্তি অপসারণ করেন। এরপর তিনি বলেন, আর কখনো এখানে উজ্জার উপাসনা হবে না। (আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৪/৩১৬)
নবম হিজরির রমজান মাসে তায়েফের সাকিফ গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের উপাস্য ‘লাত’ নামক মূর্তি অপসারণ করে। (আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৫/৩১৬)
কাদেসিয়ার যুদ্ধ ও স্পেন জয়
এক বর্ণনা অনুযায়ী কাদেসিয়া যুদ্ধ ১৫ হিজরি সালের রমজান মাসে সংঘটিত হয়। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমান ও রুস্তম ফাররাখজাদের নেতৃত্বে পারসিকদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৯/৬১৩)
এ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ছিল সর্বসাকল্যে ৩৬ হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি। আর কাফিরদের সৈন্য ছিল দুই লাখ। চার দিন ও তিন রাত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলার পর কাদেসিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাত্র ৩৬ হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ সুসজ্জিত পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে। এ যুদ্ধের ফলে ওই অঞ্চল ইরাকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং সেখানে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সব বাধা দূরীভূত হয়।
৯২ হিজরি সালের ২৮ রমজান সিপাহসালার তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী রডারিকের সৈন্যকে পরাজিত করে স্পেন জয় করে। স্পেন জয় ইউরোপে ইসলাম প্রচারে সবিশেষ ভূমিকা রাখে। এসব ইতিহাস মুসলমানদের কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
সন্ধি কিংবা বিকল্প মাধ্যমে শান্তি
ইসলামের যুদ্ধনীতি মহানবী (সা.)-এর মক্কার জীবনে কোনো যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। ইসলাম প্রথমে যুদ্ধ না করে সন্ধি কিংবা বিকল্প মাধ্যমে শান্তি চেয়েছে। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যাশা করো না। বরং আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চাও। এরপরও যদি শত্রুর সম্মুখীন হয়ে পড়ো, তবে ধৈর্য ধারণ করবে।’ (বুখারি : ৩/১১০১, মুসলিম : ৫/১৪৩)
প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফলে যুদ্ধ যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে রক্তপাত কমিয়ে আনার জন্য ইসলাম বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে। এক হাদিসে ইসলামের যুদ্ধনীতি এভাবে এসেছে, ‘তোমরা বেরিয়ে পড়ো আল্লাহর নাম নিয়ে, আল্লাহকে সঙ্গী করে, আল্লাহর রাসুলের আদর্শ ধারণ করে। অসহায় বৃদ্ধ, ছোট শিশু-কিশোর ও নারীদের হত্যা করো না। গনিমতের মাল আত্মসাৎ করো না। সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করো। সমঝোতার চেষ্টা করো। সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ সদয় আচরণকারীদের ভালোবাসেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬১৪)
ইসলামের যুদ্ধনীতি সবচেয়ে মানবিক
যুদ্ধক্ষেত্রেও মানব হত্যার বিরুদ্ধে এমন কঠোরতা প্রদর্শনের কারণে দেখা যায়, অন্য সব ধর্ম ও সভ্যতার তুলনায় ইসলামের সমরনীতি সবচেয়ে মানবিক। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় আট বছরে ছোট-বড় মোট ৮২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে উভয় পক্ষের সর্বমোট নিহতের সংখ্যা এক হাজার ১৮।
অথচ সভ্যতার দাবিদারদের দুটি বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। গির্জাকেন্দ্রিক শাসনামলে শুধু ধর্মীয় আদালতের নির্দেশে বাস্তবায়িত হত্যার সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে তিন লাখ ৪০ হাজার জন কেবল স্পেনের। তাদের ৩২ হাজারকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব
বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এই অপরিমেয় সম্মান ও মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এটা নিছক কোনো যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এর প্রকৃত রূপ ছিল অকল্পনীয় রকম কঠিন এবং প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
এ জন্য শরিয়ত প্রণেতা [রাসুলুল্লাহ (সা.)] তাদের মর্যাদাপূর্ণ জান্নাত ফেরদাউসের উচ্চ স্তর লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা ২৫৮)