যেসব জিনিসের জাকাত দেওয়া ফরজ
ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ জাকাত। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো- নামাজ ও জাকাত। কোরআন মজিদের বহু স্থানে নামাজ ও জাকাতের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
জাকাত কাদের ওপর ওয়াজিব, কী কী জিনিসে জাকাত ওয়াজিব হয় এবং জাকাত কাদের দেওয়া যায়— ইত্যাদি বিষয়সহ আরও অন্যান্য জাকাতের বিষয় নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক লেখা রয়েছে। এই লেখায় আলোচনা করা হবে— কোন কোন জিনিসে জাকাত ফরজ হয় বা জাকাত দিতে হয়।
বিজ্ঞাপন
এক.
সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।
দুই.
সোনা-রুপার অলংকার সর্বদা বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক— সর্বাবস্থাতেই তার জাকাত দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৫; সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২৫৮; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭০৫৪-৭০৬১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৯৯৭৪)
তিন.
অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও জাকাত ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬১; ৭০৬৬; ৭১০২)
চার.
জামা-কাপড় কিংবা অন্য কোনো সামগ্রীতে সোনা-রুপার কারুকাজ করা থাকলে তা-ও জাকাতের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যে পরিমাণ সোনা-রুপা কারুকাজে লেগেছে— অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে তারও জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৬৪৮-১০৬৪৯)
সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা ও মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (কিতাবুল আছার, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৪৪৭-৪৪৮)
মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার জাকাত আদায় করা ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭০৯১-৭০৯২)
তদ্রূপ ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও জাকাত ফরজ হয়।
পাঁচ.
টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে জাকাত ফরজ হয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭; রদ্দুল মুহতার : ২/২৬২-৩০০)
ছয়.
হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে— তা-ও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে এবং নিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে— জাকাত ফরজ হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৩২; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)
সাত.
দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১/২১৮; সুনানে কুবরা, বায়হাকি : ৪/১৫৭; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃষ্ঠা : ১০৮; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩,৭১০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৫৫৭, ১০৫৬০, ১০৫৬৩)
আট.
ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর— যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি— তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭১০৩-৭১০৪)
নয়.
নিসাবের অতিরিক্ত সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা ও বাণিজ্যদ্রব্যের জাকাত আনুপাতিক হারে দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৩২-৭০৭৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৩৯০; আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৯৯)
দশ.
কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরও কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল— তাহলে এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের জাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৬৮৭২, ৭০৪০-৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫,১০৩২৭)
এগার.
বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে জাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তবে ওই সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর জাকাত আদায় করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭০৪২,৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার : ২/৩০২)