খেলার জন্য রোজা থেকে বিরত থাকা যাবে?
বাংলাদেশ ক্রিকেটদল বর্তমানে শ্রীলঙ্কা সফরে রয়েছে। সেখানে খেলা চলাকালীন ক্রিকেটারদের প্রকাশ্যে তিনজন ক্রিকেটারকে পানি পান করতে দেখা গেছে। আর তাদের ছবি দুইটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়ে পড়েছে।
এর রেশ ধরে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ক্রিকেটারদের এই কাজের সমর্থন-অসমর্থনে দুইটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। একদল আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলছেন যে, এসবের কারণে কোনো গুনাহ হবে না। কারণ তারা কষ্ট করছে এবং সফরে আছে। আর সফরে রোজা ভাঙা হলে বা না রাখা হলে কোনো গুনাহ হয় না। অপর দলের মতামত হলো- এই সফরে কেন রোজা ভাঙবে? তা জায়েজ নয়। এদের ‘ঈমান’ নাই — ইত্যাদি ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু বাস্তবতা হলো- উভয় পক্ষই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির মধ্যে রয়েছে। এই কাজের কারণে ক্রিকেটাররা ‘নাস্তিক’ হয়ে যায়নি। আবার সফরে রোজা ভাঙার কারণে তাদের গুনাহ হবে না!
বিষয়টি বুঝতে পারি এভাবে...
সফরের কারণে চার মাজহাবের প্রত্যেক মাজহাবই একথা বলেছে যে, সফরের কারণে রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে। ১৫ দিনের কম সময় কোথাও অবস্থানের নিয়ত করলে, সে মুসাফির হয়ে যায়। তবে কথা হলো- কোন ধরনের সফরে রোজা ভাঙার অনুমতি রয়েছে?
ইমাম শাফেয়ি (রহ.), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ও ইমাম মালিক (রহ.)-এর মতে যদি কেউ কোনো গুনাহের কাজের জন্য কেউ সফর করে, তাহলে তার জন্য রোজা ভাঙা বৈধ নয়। বরং এতে কবিরা গুনাহ হবে। উপরন্তু ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মতে — সফর যদি কোনো ভালো নিয়তে না হয়, তাহলে সেটা সফর-ই নয়!
আর আমাদের হানাফি মাজহাবের কথা হলো- নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করলেই তাকে মুসাফির গণ্য করা হবে। পাশাপাশি সফরের বিধি-বিধান তথা নামাজ কসর করা, সুন্নতের ক্ষেত্রে শিথিলতা এবং রোজা না রাখার ব্যাপারে শিথিলতাসহ আরও অনেক বিধান আরোপ হয়।
যদি কেউ পাপকাজের জন্য সফর করে, তাহলে তার ওপর সফরের বিধি-বিধান প্রয়োগ হবে; যদি সে নির্ধারিত দূরত্ব তথা ৭৮ কি. মি. অতিক্রম করে! গুনাহ হবে; তবে সেটার মাসআলা পরে আলোচনা করা হচ্ছে।
এখন ক্রিকেট খেলা বা ফুটবল খেলার জন্য যদি কেউ বাংলাদেশ থেকে ৭৮ কি. মি. অতিক্রম করে, তাহলে হানাফি মাজহাবে তার জন্য রোজা ভাঙা বা না রাখা বৈধ হবে। পাশাপাশি তার জন্য নামাজ কসর পড়া ওয়াজিব। এটাই আমাদের মাজহাবের চূড়ান্ত বিধান।
অনেক ভাই এই বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন। ক্রিকেটারদের নাস্তিক বানিয়ে দিচ্ছেন, যা আদৌ কোনোভাবেই উচিত নয়। আবার অপরদিকে আরেক দল বলছেন যে, তারা দেশের জন্য কষ্ট করছে। রোজার মাসে কষ্ট করে গিয়েছে! তো এরকম ব্যক্তিদের জন্য কোরআনে রোজা না রাখার অনুমতি আছে!
নাউজুবিল্লাহ! এধরনের ভয়াবহ কথা আমাদের ফেস করতে হচ্ছে। তাদের মত অনুযায়ী এই ধরনের সফরে রোজা ভাঙার বিষয়টি একেবারেই মামুলি! এবং প্রকারন্তরে তারা বর্তমান প্রচলিত খেলাধুলাকে জায়েজ বলার প্রাণন্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সময়ের প্রচলিত ক্রিকেট-ফুটবল, হকি, ভলিবল, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, জিমন্যাসটিকস, টেবিল টেনিস, স্কোয়াশ, ড্রাইভিং, হাডুডুডু, ব্যাডমিন্টন, এ্যথলেটিকস, সাঁতার, জুড়ো, ক্যারাটে, কুংফু, বক্সিং, কুস্তি, ভারোত্তোলন, শ্যূটিং, ওয়াটার পোলো, দাবা, ছক্কা-পাঞ্জা, গাফলা, তাস— এগুলা শরিয়তে দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ। সেগুলা জায়েজের পন্থা বের করতে হলে, যথেষ্ট শর্তসাপেক্ষে বলতে হবে। এই বিষয়টি আমাদের আলোচ্য নয়। পরে কখনো আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
এখন কথা হলো- রোজা ভঙ্গ করলে কোনো গোনাহ হবে কিনা? এখানে মূল বিষয় হলো- হুকুম প্রয়োগ হওয়া আর গুনাহ হওয়া দুইটি ভিন্ন বিষয়। আমাদের মাজহাব অনুযায়ী পাপ কাজের জন্য সফর করলেও তার ওপর সফরের বিধান প্রয়োগ হবে। সেই দিক দিয়ে রোজা ভঙ্গের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু যে কাজের জন্য সফর করেছে তা হারাম এবং অনর্থক কাজের জন্য ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম রোজা ভাঙা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বড় অপরাধ করেছে, এর হিসেব ও আলোচনা ভিন্ন। এই জন্য তাদের গুনাহ হবে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে
তিন তালাক দেওয়া নাজায়েজ; মাকরুহে তাহরিমি। তবে তিন তালাক দিলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। কিন্তু স্বামী গুনাহগার হবে। অর্থাৎ তার হারাম কাজের বিধান প্রয়োগ হবে ঠিকই, তবে সে গোনাগার হবে। যে রকমভাবে কেউ অনিচ্ছাকৃত পানি গিলে ফেললে, তার গুনাহ যদিও হবে না; কিন্তু তার রোজা ভেঙে যাবে এবং পরে তা কাজা করতে হবে।
মোটকথা, তারা শরিয়তের দৃষ্টিতে মুসাফির এবং রোজা না রাখার অনুমতি আছে ঠিকই— কিন্তু অনর্থক হারামকাজে রোজা ভাঙার কারণে গুনাহগার হবে।
এধরনের লোকদের ব্যাপারেই আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন—
আল্লাহ তাআলা সফরে রোজা ভাঙার ও না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো চান না যে, পাপকাজের জন্য বান্দাহ সফর করুক — এটা তিনি কখনো চান না।
অতএব, রোজা ভাঙার অনুমতি থাকলেও এধরনের কাজে রোজা ভাঙলে বরং বেশি গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রমজানের পবিত্রতার মূল্য প্রত্যেক মুসলমানের কাজে-কর্মে প্রকাশ হওয়া জরুরি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে রোজা পালনের তাওফিক দান করুন।
কৃতজ্ঞতা : হানাফি ফিকহ গ্রুপ