ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। এ শহরের অলি-গলি থেকে শুরু করে বড় রাস্তাগুলোর পাশে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘুম ভাঙে আজানের শব্দে। পাড়া-মহল্লায় দৈনিক পাঁচবার নামাজের আহ্বানে দলবেঁধে মানুষ মসজিদে আসেন। 

বহু শতকের পুরনো শহর ঢাকায় অনেক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। যেগুলো বহন করছে নানা ইতিহাস।

ঢাকার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ বায়তুল মোকাররম। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। শহরের বহুল পরিচিত ও চর্চিত মসজিদের একটি এটি। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে মক্কার কাবা ঘরের আদলে। এর চমৎকার স্থাপত্যশৈলী দারুণ দৃষ্টিনন্দন। তৎকালীন পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য ৮.৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। তখন মসজিদের জায়গায় একটি বড় পুকুর ছিল। যেটি ‘পল্টন পুকুর’ নামে পরিচিত ছিল। পরে পুকুরটি ভরাট করা হয়। ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মসজিদের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।

 তবে ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি আব্দুল লতিফ বাওয়ানি নিজে বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২ বছর পর ১৯৬২ সাল নাগাদ মসজিদ নির্মাণের মূল কাজ মোটামুটি শেষ হয়। তবে সম্পূর্ণ মসজিদের কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে। 

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের স্থপতি এ এইচ থারানি মসজিদটির নকশা প্রণয়ন করেন। তিনি মসজিদের নকশায় দোকান, অফিস, গ্রন্থাগার ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রাথমিকভাবে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো এই মসজিদে নামাজ পড়া হয়।

সুবৃহৎ এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। অনেকে মনে করেন, ধারণক্ষমতার দিক থেকে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদটিতে সবচেয়ে বেশি মুসল্লির সমাগম হয় শুক্রবার জুমার নামাজে। এছাড়া রমজান মাসে তারিবর নামাজে বেশি মানুষ নামাজ পড়তে আসেন। বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার মসজিদের ধারণক্ষমতা ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজারে উন্নীত করে।

বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে নামাজ আদায় ছাড়াও মুসলমানদের ধর্মীয় কার্যক্রম, আলোচনা সভা ও ইসলামি শিক্ষা প্রদানের নানা আয়োজন হয়। এটি বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে সংরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কাবাঘরের গিলাফের একটি অংশ। যা সৌদি আরবের বাদশাহ্ খালিদ ইবন্ আবদুল আজিজ আল সাউদ বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সউদি আরব সফরকালে উপহার দেন। এই গিলাফে সুরা হাজ্জ-এর ২৬ নম্বর আয়াত লেখা আছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। 

বর্তমানে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদটি আটতলা। নিচতলায় রয়েছে একটি মার্কেট কমপ্লেক্স। দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় আদায় করা হয় নামাজ।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনও রয়েছে। সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা ঘরের অনুরূপ আদলে তৈরি বায়তুল মোকাররমের বৃহৎ চৌ-কোনা ভবন এটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। যা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো মসজিদ থেকে এটিকে আলদা করেছে।

বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রবেশ পথ রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। মসজিদে প্রবেশ করার পর রয়েছে কয়েকটি বারান্দা। সেগুলোতে তিনটি অশ্বখুরাকৃতি খিলানপথ রয়েছে। দুটি উন্মুক্ত অঙ্গন (ছাদহীন ভেতরের আঙ্গিনা) মসজিদের প্রধান নামাজ কক্ষে আলো ও বাতাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। 

তিনদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা প্রধান নামাজ কক্ষের মেহরাবটির আকৃতি আয়তাকার। এর আয়তন২ হাজার ৪শ ৬৩ বর্গ মিটার। মসজিদের ভেতরে সবার জন্য অজু করার ব্যবস্থা আছে। মহিলাদের জন্য রয়েছে পৃথক নামাজ কক্ষ ও পাঠাগার।

বায়তুল মোকাররম মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর ও নান্দনিক একটি স্থাপনা। প্রতি শুক্রবার দূরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন এই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে। ঢাকার বাইরের অনেক মানুষ এবং বিদেশি পর্যটকরা মসজিদের সৌন্দর্য ও স্থাপত্য শৈলী দেখতে আসেন।

আরএইচটি/জেএস