আবু বকর রা. যেভাবে নবীজি সা.-এর হিজরতের সঙ্গী হলেন
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসাল্লাম সাধারণ মুসলমানদের হিজরতের অনুমতি দেওয়ার পর সবাই মদিনায় চলে যেতে লাগলেন। হিজরতের অনুমতির পর দুর্বল ও অক্ষম ছাড়া সবার ওপর হিজরত করা ফরজ ছিল। সাধারণ মুসলমানদের তাৎক্ষণিক হিজরতের অনুমতি দেওয়া হলেও নবীজির ওপর হিজরতের আদেশ এসেছিল কিছুটা বিলম্বে।
মুসলমানদের হিজরত শুরুর পর মুশরিকরা যখন দেখল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ নিয়ে মদিনায় পাড়ি জমাচ্ছেন তখন তারা নিশ্চিত বিশ্বাস করে নিল, মুসলিমরা অচিরেই মদিনায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন।
বিজ্ঞাপন
তারা জানত যে, মদিনা সুরক্ষিত একটি অঞ্চল এবং তার অধিবাসীরা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী। অচিরেই মদিনায় মুসলিমরা শক্তিশালী হয়ে যাবে। তারা আশঙ্কা করল সাধারণ মুসলমানদের মতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মদিনায় হিজরত করবেন।
বিষয়টি নিয়ে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই নবীজিকে আটকাতে দারুন নাদওয়ায় পরামর্শের জন্য একত্রিত হলো। তাদের বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোকদের সবাই উপস্থিত হলো সভায়। এই পরামর্শ সভায় তাদের শুভাকাঙ্খী হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল ইবলিস। সে একজন নজদী শায়খের বেশ ধারণ করে শরীরে লম্বা চাদর জড়িয়ে বৈঠকে উপস্থিত হযেছিল।
সবাই উপস্থিত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে পরামর্শ শুরু করল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে লাগল।
কেউ কেউ পরামর্শ দিল, মুহাম্মদ সা.-কে শৃঙ্খলিত করে কোনো ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত। কিন্তু অন্যরা মতামত দিল যে মুহাম্মদ সা.-এর সঙ্গী-সাথীরা হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে। তাই ওই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা হলো।
কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিল, তাকে নির্বাসিত করা উচিত। কিন্তু তিনি যেখানে যাবেন, সেখানেই তার অনুগামী বাড়তে থাকবে এবং আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে—নজদী শায়খ বেশধারী বৈঠকের শুভাকাঙ্খী ইবলিসের কাছে কোন মতামতই পছন্দ হচ্ছিল না।
সবশেষে আবু জাহেল বলল- আমি মনে করি প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী যুবককে আমরা বেছে নিব। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ধাঁরালো তলোয়ার থাকবে। তারা সকলে মিলে এক সাথে এক আঘাতেই মুহাম্মাদকে হত্যা করে ফেলবে। এতে সকল গোত্রের মধ্যে তার রক্ত ভাগ হয়ে যাবে। তারপর আব্দে মানাফ গোত্রের (মুহাম্মাদেও গোত্রের) লোকেরা এ ব্যাপারে কোন সিদ্বান্ত নিতে পারবে না। তাদের পক্ষে সকল গোত্রের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করা ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আর দিয়ত দেয়ার প্রয়োজন হলে আমরা সকলে মিলেই তা পরিশোধ করে দিব।
এই প্রস্তাব শুনে নজদী শায়খ বেশধারী শয়তান বলল- আল্লাহর শপথ! এটিই হচ্ছে সঠিক প্রস্তাব। তারা সকলে এই প্রস্তাবের উপরেই একমত হয়ে মজলিস ত্যাগ করল।
আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দিলেন এবং তাকে হিজরতের আদেশ দিলেন।
আরও পড়ুন
আল্লাহর আদেশের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের চেহারা মুবারক আবৃত করে দুপুর বেলা হজরত আবু বকরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। তিনি তাকে বললেন- তোমার আশেপাশে যারা আছে তাদের সকলকে বের করে দাও। সেখানে শুরু আসমা ও আয়েশা রা. ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা.-কে বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বকর রা. তখন বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনার সফর সঙ্গী হবেন কে? আল্লাহর রাসূল বললেন, তুমিই হবে আমার সফর সঙ্গী।
একথা শুনে আবু বকর রা. এতোটাই আনন্দিত হলেন যে খুশিতে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আগে থেকেই দুটি উটনী কিনে রেখেছিলাম। উটগুলোকে ভালোভাবে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করে রেখেছি। তার একটি আমি আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। আল্লাহর রাসূল উটের মূল্য পরিশোধ করলেন। আবু বকর রা. নিতে না চাইলেও তাকে অগত্যা উটের মূল্য নিতে হলো।
তখন থেকেই হিজরতের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. ছাতুর থলে এবং খাবার দাবার ঠিক করলেন।
আবু বকর রা.-কে হিজরতের খবর দিয়েই আল্লাহর রাসূল সা. নিজের ঘরে এলেন। সেদিনের রাতটিই ছিল মুশরিকদের আগের রাতের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্ধারিত রাত। আজ রাতেই তারা নবী মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করবে।
সন্ধ্যা নামার পর তারা নবীজির বাড়ির সামনে অবরোধ করল। তারা অপেক্ষায় রইলো রাতে কখন নবীজি সা. নামাজের জন্য বের হবেন তখন তারা তাকে হত্যা করবে।
সে রাতে রাসূল সা. নিজের বিছানায় আলী রা.-কে ঘুমাতে বললেন। আলী রা. চাদর মুড়ি দিয়ে রাসূল সা.-এর বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মক্কাবাসীর যেসব দ্রব্য আল্লাহর রাসূলের কাছে আমনত হিসেবে রাখা ছিল তাও তিনি আলী রা.-এর কাছে বুঝিয়ে দিলেন মালিকদের হাতে সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে এক মুষ্ঠি মাটি হাতে নিয়ে কাফেরদের মাথায় নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তিনি মাটি নিক্ষেপের সময় কোরআনের এই আয়াতটি পাঠ করেছিলেন-
وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ
‘‘এবং আমি তাদের সামনে ও পিছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা দেখে না’’। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত, ৯)
এর ফলে রাসূল সা. তাদের চোখের সামনে দিয়ে বের হয়ে গেলেও তারা আর রাসূল সা.কে দেখতে পেলো না। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি আবু বকরের বাড়ির দিকে গেলেন। তারা উভয়েই রাতের অন্ধকারে বের হয়ে পড়লেন।
তারা উভয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর এক লোক পাহারায় থাকা মুশরিক যুবকদের এসে বললো- তোমরা কিসের অপেক্ষা করছ? তারা বলল- আমরা মুহাম্মাদের অপেক্ষা করছি। সে বলল- তোমরা ব্যর্থ হয়েছো, তোমাদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার নয়। আল্লাহর শপথ! সে তোমাদের পাশ দিয়েই বের হয়ে গেছে। সে তোমাদের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে চলে গেছে।
তারা মাথায় হাত দিয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই তাদের মাথায় মাটি রয়েছে। তখন তার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মাথা থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলতে লাগল।
সকাল বেলা আলী রা. নবীজির ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তারা তাকে নবীজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। এদিকে ততক্ষণে আবু বকর রা.-কে সঙ্গে নিয়ে গারে সওরে প্রবেশ করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
(ইসলামের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ১২৭)