ইফতারে খেজুর খেতেই হবে?
সারাদিন রোজা শেষে ইফতার করা সুন্নত। ইফতার বরকতময় খাবার। দেশ, সমাজ, অঞ্চলভেদে ইফতারে খাবারের ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশে ইফতার আয়োজনে সাধারণত ভাজাপোড়া ও মুখোরোচক খাবার খেতে দেখা যায়। এসব খাবারের সঙ্গে প্রধান খাবার হিসেবে থাকে খেজুর।
মহানবী সা.-এর ইফতারে খেজুর
বিজ্ঞাপন
মুসলিম সমাজে ইফতারে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে। আরবের অন্যতম প্রধান খাবার খেজুর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ইফতারে খেজুর খেতেন এবং সাহাবিদেকেও তিনি ইফতারে খেজুর খেতে বলেছেন।
এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তাতে বরকত রয়েছে।’ (তিরমিজি, মেশকাত, ১৮৯৩)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইফতারের পাতে বেশির ভাগ সময় কাঁচা খেজুর থাকত। কাঁচা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুরও খেতেন তিনি।
আরও পড়ুন
হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (তিরমিজি, হাদিস, ৬৩২)
খেজুর ছাড়াও আল্লাহর রাসূলের ইফতারে তৎকালীন আরবের প্রচলিত খাবার খাওয়ার প্রমাণ রয়েছে হাদিসে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি আউফ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রোজায় আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বললেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন করো।’ (মুসলিম, হাদিস, ১০৯৯)
ইফতারে খেজুর খাওয়া সুন্নত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ও হাদিসের আলোকে ইফতারে খেজুর খাওয়া সু্ন্নত। সারাদিন রোজা শেষে ইফতার গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় হওয়ার কারণে মুসলমানদের সবাই ইফতারে খেজুর রাখেন এবং আল্লাহর রাসূলের সুন্নতের অনুসরণের চেষ্টা করেন।
সুন্নত অনুসরণের পাশাপাশি ইফতারের খাবারে খেজুর সুস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।সারাদিন রোজা রাখার ফলে পেট খালি থাকার কারণে শরীরে যে গ্লুকোজের ঘাততি দেখা দেয়, খেজুর তা দ্রুত পূরণে সাহায্য করে। একই সঙ্গে খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি থাকায় সারাদিনের ক্লান্তি শেষে খেজুর খেলে দ্রুত দুর্বলতা কেটে যায়।
ইফতারে খেজুর খেতে না পারলে...
সুন্নতের অনুসরণ ও স্বাস্থ্যগত কারণে ইফতারের খাবারে এবং ইফতার শুরু করার ক্ষেত্রে খেজুরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন মুসলমানেরা। তবে কোনো কারণে ইফতারে খেজুর খেতে না পারলে অথবা খেজুরের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কেউ খেজুর কিনতে না পারলে তার ইফতার হবে না— বিষয়টি এমন নয়।
একজন মুসলিমের মনে রাখতে হবে রমজান মাসে রোজা ফরজ এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এই মাসে রোজাকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। রোজা ত্রুটিমুক্ত রাখতে ফরজগুলো ঠিকমতো পালন করতে হবে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুন্নতগুলো ঠিকমতো আদায় করতে হবে। অবহেলায় ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন
তবে কোনো সুন্নতকে রোজা পালনের জন্য আবশ্যকীয় এবং পালন করতে না পারলে রোজা হবে না— এমন ভাবার কারণ নেই।
রাসূল সা.-এর সুন্নতের প্রকারভেদ
রাজধানীর জামিয়া ইউসুফ বানুরীর মুহতামিম ও মাহমুদ নগর জামে মসজিদের খতিব মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ বলেছেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত দুই প্রকার। এক. সুন্নতে মুয়াক্কাদা (যে সু্ন্নতের ওপর রাসূল সা. নিয়মিত এমনভাবে আমল করতেন যে তা ওজরবিহীন (বিশেষ অপারগতা) কখনো ছাড়তেন না)। দুই. সুন্নতে জায়েদা (যে সুন্নতের ওপর রাসূল সা. নিয়মিত আমল করলেও ওজরবিহীন মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিতেন।)
আল্লাহর রাসূলের ব্যক্তিগত আমল ও শরীয়তের বিধান
তিনি বলেন, রাসূল সা. কিছু কিছু কাজ করেছেন নবী হিসেবে- তা উম্মতের জন্য পালন করা আবশ্যক। আবার তিনি কিছু কাজ করেছেন মানুষ বা ব্যক্তি হিসেবে— আল্লাহর রাসূল ব্যক্তি হিসেবে যেসব কাজ করেছেন, তা পালন করা উম্মতের ওপর আবশ্যক নয়, তবে মেনে চলা ও অনুসরণের অনেক বরকত ও ফজিলত রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাদা কাপড় পরতে পছন্দ করতেন। সাদা কাপড় তার ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল, তাই তিনি পোশাকের ক্ষেত্রে সাদা কাপড় প্রাধান্য দিতেন, শরীয়তের বিধান হিসেবে কখনো তিনি সাদা কাপড় পরেননি। আমরা সাদা কাপড় পরলে বরকত আছে তবে না পরলে কোনো গুনাহ হবে না। ঠিক তেমনি আল্লাহর রাসূল পুষ্টিগুণ এবং তৎকালীন মদিনার প্রধান খাবার হিসেবে খেজুর খেতেন। শরীয়তের বিধান হিসেবে খেজুর খেতেন না।
খেজুর খাওয়া বরকতের কারণ...
আল্লাহর রাসূলের সুন্নতের অনুসরণে ইফতারে খেজুর খাওয়া বরকতের কারণ। তবে কেউ বিশেষ কোনো অসুস্থতা বা দাম বৃদ্ধি এবং এ জাতীয় কারণে খেজুর খেতে না পারলে তাকে এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, সে সুন্নত ছেড়ে দিয়েছে, সুন্নতের ওপর আমল করেনি- বলেন মাওলানা আতাউল করিম মাকসুদ।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ইফতার সামগ্রী ও খেজুর কেনা কষ্টসাধ্য হলে, বরকত লাভের জন্য পরিমাণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, কেউ আগে তিনটা খেজুর খেত, এখন একটা খাওয়া যেতে পারে।
সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী...
তিনি বলেন, বর্তমানে রমজানে মূল্যবৃদ্ধি একটি জাতীয় সমস্যা। এ কারণে পবিত্র মাসে ইবাদত পালনের আগে খাবার-দাবার নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়। অনেকে খাবারের তালিকা কাটছাট করার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ীদের উচিত অধিক মূনাফা লাভের আশা না করে রমজানে মানুষের ইবাদত পালনের বিষয়টি সহজিকরণে সহযোগিতা করা।
আল্লাহর রাসূল সা. সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। রমজানে অযাচিতভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার ও খেজুরের মূল্য বৃদ্ধি না করে ব্যবসায়ীদের আল্লাহর রাসূলের বর্ণিত পুরস্কার অর্জনে প্রতিযোগীতা করা উচিত।