তাবলিগ জামাতের সবার কাছে সমাদৃত যে চার আলেম
তাবলিগ জামাতের সূচনা হয়েছিল একজন আলেমের মাধ্যমে। এরপর আলেমদের তত্ত্বাবধায়নেই তাবলিগের কাজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাবলিগের সূচনাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আলেমরাই এর আমির ও শূরার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাবলিগের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক রাহবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন অনেক আলেম। তাবলিগের সর্বমহলে পরিচিত এমন চারজন আলেমের জীবনী তুলে ধরা হলো এখানে।
বিজ্ঞাপন
মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি
তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠ করেছিলেন মাওলানা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহিমাহুল্লাহ। এই কাজ এগিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। কাজ শুরু পর আমৃত্যু জামাতটির আমির ছিলেন তিনি।
ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলার অন্তর্গত কান্ধলা নামক স্থানে ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। শিশুকালেই কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা নিজ ঘরে অর্জন করেন।
তিনি বড়ভাই ইয়াহইয়া কান্ধলভির সঙ্গে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর সান্নিধ্যে থেকে ১০ বছর আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। ১৩২৬ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। দেওবন্দে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ.-এর কাছে তিনি বুখারি ও তিরমিজি শরিফ পড়েন। তিনি দ্বীনহারা মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার মহৎ উদ্দেশ নিয়ে ১৯২৬ সালে উত্তর ভারতের মেওয়াত অঞ্চল থেকে শুরু করেন তাবলিগের কাজ।
তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমের ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। বিংশ শতাব্দীর এ মহান ধর্মপ্রচারক ১২ জুলাই ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি
মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর ছেলে। তিনি ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলার কান্ধলা নামক স্থানে ২০ মার্চ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ রোজ বুধবার জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন। হিফজ সম্পন্ন করে বাবা মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. এরপর তাবলিগ জামাতের আমিরের পদে অধিষ্ঠিত হন মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহ.।
শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ.-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ পড়েন। শায়খ ইলিয়াস রহ.-এর মৃত্যুর পর তাবলিগের মুরব্বিরা তার মাথায় আমিরের পাগড়ি পরিয়ে দেন। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাবলিগ ও দাওয়াতের মেহনতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ‘আমানিল আহবার-বিখ্যাত হাদিসের কিতাব শরহু মা’আনিল আছারের ভাষ্যগ্রন্থ, ‘হায়াতুস সাহাবা’ সাহাবিদের জীবনীগ্রন্থ ‘মুন্তাখাব হাদিস’-তাবলিগ জামাতের ছয় নম্বর সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদিসসমূহ, তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সংবলিত অমর গ্রন্থ ।
আরও পড়ুন
ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ রহ. বাংলাদেশে তাবলিগের সফরে আসেন। সে সময় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে এসেছিলেন তিনি। তাবলিগের এক সফরে ২৯ জিলকদ ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ২ এপ্রিল ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা এনামুল হাসান
তাবলিগের কাজকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে যারা আমরণ চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মাওলানা এনামুল হাসান। তিনি গোটা জীবনকে ইলমে ওহির খেদমতের পাশাপাশি দ্বীনি দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি তাবলিগ জামাতের তৃতীয় মুরব্বি।
তিনি ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধালা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মাওলানা ইকরামুল হাসান। বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।
আনুমানিক নয় কিংবা দশ বছর বয়সে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরব্বি মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর তত্ত্বাবধানে নিজামুদ্দিন চলে আসেন এবং মাওলানা ইলিয়াস ও মাওলানা এহতেশামুল হাসানের কাছে আরবি ভাষা-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবাদি অধ্যয়ন করার সময়ই শিক্ষক-মুরব্বি মাওলানা ইলিয়াসের নজর কাড়েন এনামুল হাসান।
১৯৬৫ সালে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা ইউসুফ কান্দলভি রহ ইন্তেকালের পর শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া রহ. তাকে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির হিসাবে মনোনীত করেন। এ মহান মনীষী ১৯৯৫ সালের ১০ জুন ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা জুবায়েরুল হাসান
মাওলানা জুবায়েরুল হাসান ছিলেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক। ভারতের নিজামুদ্দীন মারকাজের শূরার অন্যতম শীর্ষ সদস্য। তাবলিগ জামাতের একক কোনো আমির না থাকলেও তাকেই শীর্ষ মুরব্বি হিসাবে মানতেন সবাই। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ৩০ মার্চ। প্রাথমিক পড়াশোনা বাবা মাওলানা এনামুল হাসানের কাছে সম্পন্ন করেন। শৈশবেই কোরআন শরিফ হিফজ সম্পন্ন করেন।
১৯৭১ সালে ভারতের প্রখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর থেকে তিনি পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে শিক্ষাদান ও দাওয়াতি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট প্রথম মাদ্রাসায়ে কাদিমের মসজিদে তাবলিগ জামাতের সঙ্গীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এরপর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জড়িত ছিলেন নবিওয়ালা এ কাজের সঙ্গে।
বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল মাওলানা জুবায়েরুল হাসানের।
প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগতীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় তিনি নিয়মিত আসতেন। ইজতেমার বিশেষ আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন তিনি। মোনাজাতের আগে তাবলিগের ছয় উসুলের ওপর হেদায়াতি বয়ানও করতেন তিনি।
এ মহান মুরব্বি ১৮ মার্চ ২০১৪ সালে রোজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ড. রাম মানোহার লুহিয়া হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
তার ইন্তেকালের পর তাবলিগ জামাত পরিচালায় একক আমিরে ফায়সাল মানা হবে নাকি আলমী শূরার মাধ্যমে বৃহৎ এই জামাতটি পরিচালিত হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়। যা এখনো চলমান।
এনটি