প্রতীকী ছবি

সূরা বালাদ পবিত্র কোরআনের ৯০ নম্বর সূরা। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ এবং পবিত্র কোরআনের ত্রিশতম পারায় অবস্থিত। এর আয়াত সংখ্যা ২০।

সূরা বালাদ


لَاۤ اُقۡسِمُ بِہٰذَا الۡبَلَدِ ۙ ١ وَاَنۡتَ حِلٌّۢ بِہٰذَا الۡبَلَدِ ۙ ٢ وَوَالِدٍ وَّمَا وَلَدَ ۙ ٣ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ کَبَدٍ ؕ ٤ اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّنۡ یَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ اَحَدٌ ۘ ٥ یَقُوۡلُ اَہۡلَکۡتُ مَالًا لُّبَدًا ؕ ٦ اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّمۡ یَرَہٗۤ اَحَدٌ ؕ ٧ اَلَمۡ نَجۡعَلۡ لَّہٗ عَیۡنَیۡنِ ۙ ٨ وَلِسَانًا وَّشَفَتَیۡنِ ۙ ٩ وَہَدَیۡنٰہُ النَّجۡدَیۡنِ ۚ ١۰ فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ ۫ۖ ١١ وَمَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡعَقَبَۃُ ؕ ١٢ فَکُّ رَقَبَۃٍ ۙ ١٣ اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ ۙ ١٤ یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ ۙ ١٥ اَوۡ مِسۡکِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ ؕ ١٦ ثُمَّ کَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَتَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَتَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ ؕ ١٧ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡمَیۡمَنَۃِ ؕ ١٨ وَالَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا ہُمۡ اَصۡحٰبُ الۡمَشۡـَٔمَۃِ ؕ ١٩ عَلَیۡہِمۡ نَارٌ مُّؤۡصَدَۃٌ ٪ ٢۰

সূরা বালাদ অর্থ :

আমি শপথ করছি এই নগরের। যখন (হে নবী!) তুমি এই নগরের বাসিন্দা। এবং আমি শপথ করছি পিতার ও তার সন্তানের। আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি পরিশ্রমের ভেতর। সে কি মনে করে তার উপর কারও ক্ষমতা চলবে না? সে বলে, আমি অঢেল অর্থ-সম্পদ উড়িয়েছি। সে কি মনে করে তাকে কেউ দেখছে না? আমি কি তাকে দেইনি দু’টি চোখ? এবং একটি জিহ্বা ও দু’টি ঠোঁট? আমি তাকে দু’টো পথই দেখিয়েছি। তবুও সে প্রবেশ করতে পারেনি ঘাঁটিতে। 

তুমি কি জান সে ঘাঁটি কী? (তা হচ্ছে কারও) গর্দানকে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করা। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য দান করা। কোন ইয়াতীম আত্মীয়কে। অথবা এমন কোন মিসকীনকে যে ধুলো মাটিতে গড়াগড়ি খায়। আর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সেই সব লোকের, যারা ঈমান এনেছে, একে অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিয়েছে এবং একে অন্যকে দয়ার উপদেশ দিয়েছে। তারাই সৌভাগ্যবান লোক। অপর দিকে যারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছে, তারাই হতভাগ্য। তাদের উপর চাপানো থাকবে আবদ্ধকৃত আগুন।

সূরা বালাদে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে

এই সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা একটি নগরীর শপথ করেছেন। সেই নগরীটি হলো মক্কা নগরী। সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার সময় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাতেই অবস্থান করছিলেন। তার জন্মস্থানও ছিল মক্কা শহর। অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা নবী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান এবং বাসস্থানের কসম খেয়েছেন। যার কারণে তার অতিরিক্ত মর্যাদার কথা সুস্পষ্ট।

এরপরের আয়াতে সেই সময়কার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যখন মক্কা বিজয় হয়েছিল। 

এরপর বনী আদম বা মানব জাতির শপথ করা হয়েছে। এখানে আদম আলাইহিস সালাম থেকে তার ঔরসে জন্ম গ্রহণকারী ও দুনিয়ার সমস্ত মানুষ অন্তর্ভুক্ত। যারা বর্তমানে পৃথিবীতে আছেন, যারা অতীতে অতিবাহিত হয়েছেন এবং যারা ভবিষ্যতে আসবেন সবাই অন্তর্ভুক্ত। এভাবে এতে আদম ও দুনিয়ার আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব বনী-আদমের শপথ করা হয়েছে।

এরপর বলা হয়েছে, মানুষের জীবন পরিশ্রম ও দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ।

এরপর মানুষের কিছু বদ অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। আর তাহলো দান করে বলে বেড়ানো। মানুষ দুনিয়ার ব্যাপারে এবং ফালতু কাজে অনেক পয়সা ব্যয় করে এরপর গর্বের সাথে লোকের কাছে তা বলে বেড়ায়। (অথবা সে দ্বীনের ব্যাপারে অর্থ ব্যয় করে, অতঃপর আক্ষেপের সাথে লোকের কাছে তা বলে বেড়ায়।

এমনিভাবেই আল্লাহর নাফরমানীতে অটল থেকে সম্পদ খরচ করে আর ভাবে যে, তার পরিদর্শনকারী কেউ নেই। অথচ আল্লাহ সবই দেখছেন এবং সে ব্যাপারে তাকে তিনি সাজা দেবেন।

পরবর্তী আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা কিছু নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন; যাতে এমন মানুষেরা উপদেশ গ্রহণ করে।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুটি চোখ দিয়েছেন, জিহ্বা ও ঠোট দিয়েছেন। জিহ্বা ‍দিয়ে সে কথা বলে এবং নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। আর ওষ্ঠাধর (দুই ঠোঁট) দিয়ে সে বলা এবং খাওয়ার কাজে সহযোগিতা নিয়ে থাকে। এ ছাড়া এগুলো তার চেহারা ও মুখমন্ডলের সৌন্দর্যের বিশেষ কারণও বটে।

এরপর আল্লাহ তায়ালার দেওয়া অন্যতম এক নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে, তাহলো ভালো এবং মন্দের পার্থক্য ও হেদায়েত প্রদান। বলা হয়েছে, ভাল ও মন্দ, ঈমান ও কুফর, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের উভয় প্রকার পথই দেখিয়েছি আমি মানুষকে।

এরপর আবার গাফিল মানুষকে হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, এসব উজ্জ্বল প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত, কিয়ামতে পুনরুজ্জীবন ও হিসাব-নিকাশের নিশ্চিত বিশ্বাস হওয়া উচিত ছিল এবং এ বিশ্বাসের ফলেই সৃষ্টজীবের উপকার করা, তাদের অনিষ্ট থেকে আত্ম- রক্ষা করা, আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, নিজের সংশোধন করা এবং অপরের সংশোধনের চিন্তা করা দরকার ছিল, যাতে কিয়ামতে সে 'আসহাবে-ইয়ামীন’ তথা জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু হততাগা মানুষ তা করেনি বরং কুফরকেই আকড়ে রয়েছে,
যার পরিণাম জাহান্নামের আগুন ৷ সূরার শেষ অবধি এ বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এতে কতিপয় সৎ কর্ম অবলম্বন না করার বিষয়কে বিশেষ ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে।

এসব সৎকর্মের মধ্যে প্রথমে দাসমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এটা খুব বড় ইবাদত এবং একজন মানুষের জীবন সুসংহত করার নামান্তর। বিভিন্ন হাদীসে এর অনেক সওয়াবের উল্লেখ এসেছে। 

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে কেউ কোন দাসকে মুক্ত করবে সেটা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে’। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৪৭, ১৫০)

দ্বিতীয় সৎকর্ম হচ্ছে ক্ষুধার্তকে অন্নদান। যে কাউকে অন্নদান করলে তা আরও বিরাট সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। তাই বলা হয়েছে, বিশেষভাবে যদি আত্মীয় ইয়াতীমকে অন্নদান করা হয়, তবে তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। 

(এক) ক্ষুধার্তের ক্ষুধা দূর করার সওয়াব এবং (দুই) আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ও তার হক আদায় করার সওয়াব। 

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন মুসলিম ক্ষুধার্তকে অন্নদান ক্ষমাকে অবশ্যম্ভাবী করে। (মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৫২৪)

এ ধরনের দানের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ইয়াতীমের হক সবচেয়ে বেশি। একদিকে সে ইয়াতীম, দ্বিতীয়ত সে তার নিকটাত্মীয়। 

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মিসকীনকে দান করা নিঃসন্দেহে একটি দান। কিন্তু আত্মীয়দের দান করা দুটি। দান ও আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/২১৪, তিরমিজি,  ৬৫৩)

এরপরের আয়াতে ঈমানের পর মুমিনের এই কর্তব্য ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সে অপরাপর মুসলিম ভাইকে সবর ও অনুকম্পার উপদেশ দেবে। সবরের অর্থ নিজেকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখা ও সৎকর্ম সম্পাদন করা। এবং অপরের প্রতি দয়াদ্র হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপরের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করে তাকে কষ্টদান ও যুলুম করা থেকে বিরত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যারা এমন করবে তাদের সৌভাগ্যবান বলা হয়েছে।

এরপর বলা হয়েছে, পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হল হতভাগ্য। তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে তার চতুর্দিক বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে আগুনের সম্পূর্ণ তাপ তাদের কাছে পৌঁছে এবং সেখান থেকে পালিয়ে কোথাও যেতে না পারে।

এনটি