প্রতীকী ছবি

সূরা আদ-দুহা পবিত্র কোরআনের ৯৩ নম্বর সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ১১। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ ও পবিত্র কোরআনের ত্রিশতম পারায় অবস্থিত। এই সূরার শানে নুজুল সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, 

সূরা আদ দোহার শানে নুযুল

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার অসুস্থ হলেন। এ কারণে তিনি একরাত বা দু’রাত সালাত আদায়ের জন্য বের হলেন না। তখন এক মহিলা এসে বলল, মুহাম্মাদ আমি তো দেখছি তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করেছে, এক রাত বা দু রাত তো তোমার কাছেও আসেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই সূরা নাজিল হয়। (বুখারি, হাদিস, ৪৯৫০, ৪৯৫১, ৪৯৮৩)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ওহী আসতে বিলম্ব হয়, এতে করে মুশরিকরা বলতে শুরু করে যে, মুহাম্মদকে তার আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন ও তার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে সূরা আদ-দুহা অবতীর্ণ হয়।  (মুসলিম, হাদিস, ১৭৯৭)

সূরা আদ দুহা

وَالضُّحٰی ۙ ١ وَالَّیۡلِ اِذَا سَجٰی ۙ ٢ مَا وَدَّعَکَ رَبُّکَ وَمَا قَلٰی ؕ ٣ وَلَلۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لَّکَ مِنَ الۡاُوۡلٰی ؕ ٤ وَلَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی ؕ ٥ اَلَمۡ یَجِدۡکَ یَتِیۡمًا فَاٰوٰی ۪ ٦ وَوَجَدَکَ ضَآلًّا فَہَدٰی ۪ ٧ وَوَجَدَکَ عَآئِلًا فَاَغۡنٰی ؕ ٨ فَاَمَّا الۡیَتِیۡمَ فَلَا تَقۡہَرۡ ؕ ٩ وَاَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنۡہَرۡ ؕ ١۰ وَاَمَّا بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ فَحَدِّثۡ ٪ ١١

সূরা আদ-দুহা বাংলা অনুবাদ

সকালের উজ্জ্বল আলোর শপথ, এবং রাতের, যখন তার অন্ধকার গভীর হয়। তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি নারাজও হননি। নিশ্চয়ই পরবর্তী সময় তোমার পক্ষে পূর্বের সময় অপেক্ষা শ্রেয়। অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে এত দেবেন যে, তুমি খুশী হয়ে যাবে। 

তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম পাননি, অতঃপর তোমাকে আশ্রয় দিয়েছেন? এবং তোমাকে পেয়েছিলেন, পথ সম্পর্কে অনবহিত; অতঃপর তোমাকে পথ দেখিয়েছেন। এবং তোমাকে নিঃস্ব পেয়েছিলেন, অতঃপর (তোমাকে) ঐশ্বর্যশালী বানিয়ে দিলেন। 

সুতরাং যে ইয়াতীম, তুমি তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করো না। এবং ভিক্ষুককে ধমক দিও না। আর আপনি আপনার রবের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দিন।

সূরা দুহায় যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে

এই সূরার শুরুতে দিনের আলো ও রাতের নীরবতা বা অন্ধকারের শপথ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে, আপনার রব আপনাকে ভুলে যাননি এবং আপনার প্রতি শক্রতাও পোষণ করেননি। আয়াতে দিন ও রাতের শপথ করার কারণ সম্ভবত এই যে, রাতের নিঝুমতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার পর দিনের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হওয়ার মতই যেন বিরতির অন্ধকারের পর ওহী আগমনের আলো উদ্ভাসিত হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত দিন দিন বেড়েই যাবে এবং প্রত্যেক প্রথম অবস্থা থেকে পরবর্তী অবস্থা উত্তম ও শ্রেয় হবে। এতে জ্ঞানগরিমা ও আল্লাহর নৈকট্যে উন্নতি লাভসহ জীবিকা এবং পার্থিব প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি সব অবস্থাই অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহর রাসূলের জন্য আখেরাত তো দুনিয়া থেকে অনেক, অনেক বেশি উত্তম হবে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছাটাইতে শোয়ার কারণে তার পার্শ্বদেশে দাগ পড়ে গেল। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, আমাদেরকে অনুমতি দিলে আমরা আপনার জন্য একটি কিছু তৈরী করে দিতাম যা আপনাকে এমন কষ্ট দেওয়া থেকে হেফাজত করত। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার আর এ দুনিয়ার ব্যাপারটি কি? আমি ও দুনিয়ার উদাহরণ তো এমন যেমন কোন সওয়ারী কোন গাছের নীচে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিল তারপর সেটা ছেড়ে চলে গেল। (ইবনে মাজাহ, ৪১০৯, মুসনাদে আহমাদ, ১/৩৯১)

এরপর বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এতো প্রাচুর্য দেবেন যে, তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। এতে কি দিবেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, প্রত্যেক কাম্যবস্তুই প্রচুর পরিমাণে দেবেন। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাম্যবস্তুসমূহের মধ্যে ছিল ইসলাম ও কোরআনের উন্নতি, সারা বিশ্বে হিদায়াতের প্রসার, শত্রুর বিরুদ্ধে তার বিজয়লাভ, শত্রুদেশে ইসলামের কালেমা সমুন্নত করা ইত্যাদি। আর তার মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে ও জান্নাতেও তাকে আল্লাহ তায়ালা অনেক অনুগ্রহ দান করবেন।

হাদিসে আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, পরবর্তীতে সময়ে মুসলমানদের হাতে যে সমস্ত জনপদ বিজিত হবে তা একটি একটি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পেশ করা হচ্ছিল। এতে তিনি খুশী হলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা ‘অচিরেই আপনার রব আপনাকে এমন দান করবেন যে আপনি সস্তুষ্ট হয়ে যাবেন’- এ আয়াত নাজিল করলেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম, ২/৫২৬)

আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলকে ভুলে যাননি এবং তাকে বিশেষ দানে সন্তুষ্ট করবেন- এই সুসংবাদ দেওয়ার পর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কিছু নেয়ামতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেছেন পরবর্তী আয়াতে। 

প্রথম নেয়ামত হচ্ছে, আমি আপনাকে পিতৃহীন পেয়েছি। আপনার জন্মের পূর্বেই পিতা ইন্তেকাল করেছিল এবং ছোট থাকতেই মা মারা যায়। অতঃপর আমি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। অর্থাৎ প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব, পরবর্তীতে পিতৃব্য আবু তালেব যত্নসহকারে আপনাকে লালন-পালন করতেন। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া আল্লাহর নেয়ামতের আলোচনায় আরও বলা হয়েছে, তিনি তাকে অনভিজ্ঞ, অনবহিত পেয়েছিলেন।নবুওয়ত লাভের পূর্বে তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে, ঈমান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। অতঃপর নবুওয়তের পদ দান করে তাকে পথনির্দেশ দেওয়া হয়, যা তিনি জানতেন না তা জানানো হয়; সর্বোত্তম আমলের তাওফিক দেওয়া হয়।

এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া আল্লাহর তৃতীয় নেয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত পেয়েছেন; অতঃপর তাকে অভাবমুক্ত করেছেন এবং ধৈর্যশীল ও সন্তুষ্ট করেছেন। 

এ নেয়ামতগুলো উল্লেখ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, ইয়াতিমের সাথে কঠোর ব্যবহার করবেন না।

দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছে, কোনো অভাবি ও দ্বীন সম্পর্কে জানে না এমন জানতে চাওয়া ব্যক্তিকে ধমক বা ভর্ৎসনা করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের সাহায্য করতে পারলে করুন আর না করতে পারলে কোমল স্বরে তাকে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু কোনক্রমে তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করবেন না। 

তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে, মানুষের সামনে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ বৰ্ণনা করুন, স্মরণ করুন। যেমন, তিনি তোমাকে হিদায়াত, রিসালত ও নবুঅত দান করেছেন, এতীম হওয়া সত্ত্বেও তিনি তোমার তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করেছেন, তোমাকে অল্পে তুষ্ট করেছেন ও অভাবমুক্ত করেছেন প্রভৃতি।

এনটি