প্রতীকী ছবি

সূরা আলাক পবিত্র কোরআনের ৯৬ নম্বর সূরা। সূরাটি পবিত্র কোরআনের ত্রিশতম পারায় অবস্থিত। এর আয়াত সংখ্যা ১৯। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে প্রমাণিত, সূরা আলাক থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহীর সূচনা হয় এবং এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত (مَا لَمْ يَعْلَمْ) সর্ব প্রথম নাজিল হয়। অধিকাংশ আলেম এ বিষয়ে একমত। 

কেউ কেউ সূরা আল-মুদ্দাসসিরকে প্রথম সূরা এবং কেউ সূরা ফাতেহাকে সর্বপ্রথম সূরা বলে অভিহিত করেছেন। তবে প্রথমোক্ত মতটিই বিশুদ্ধ। (বুখারি, হাদিস, ৬৯৮২, মুসলিম, হাদিস, ১৬০, আল-ইতকান কী উলূমিল কোরআন, ১/৯৩)

সূরা আলাক

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ۚ ١ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ۚ ٢ اِقۡرَاۡ وَرَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ ۙ ٣ الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ ۙ ٤ عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ ؕ ٥ کَلَّاۤ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَیَطۡغٰۤی ۙ ٦ اَنۡ رَّاٰہُ اسۡتَغۡنٰی ؕ ٧ اِنَّ اِلٰی رَبِّکَ الرُّجۡعٰی ؕ ٨ اَرَءَیۡتَ الَّذِیۡ یَنۡہٰی ۙ ٩ عَبۡدًا اِذَا صَلّٰی ؕ ١۰ اَرَءَیۡتَ اِنۡ کَانَ عَلَی الۡہُدٰۤی ۙ ١١ اَوۡ اَمَرَ بِالتَّقۡوٰی ؕ ١٢ اَرَءَیۡتَ اِنۡ کَذَّبَ وَتَوَلّٰی ؕ ١٣ اَلَمۡ یَعۡلَمۡ بِاَنَّ اللّٰہَ یَرٰی ؕ ١٤ کَلَّا لَئِنۡ لَّمۡ یَنۡتَہِ ۬ۙ  لَنَسۡفَعًۢا بِالنَّاصِیَۃِ ۙ ١٥ نَاصِیَۃٍ کَاذِبَۃٍ خَاطِئَۃٍ ۚ ١٦ فَلۡیَدۡعُ نَادِیَہٗ ۙ ١٧ سَنَدۡعُ الزَّبَانِیَۃَ ۙ ١٨ کَلَّا ؕ  لَا تُطِعۡہُ وَاسۡجُدۡ وَاقۡتَرِبۡ ٪ٛ ١٩

সূরা আলাকের অর্থ : 

পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি (সব কিছু) সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত দ্বারা। পড় এবং তোমার প্রতিপালক সর্বাপেক্ষা বেশি মহানুভব। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করছে। বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করছে। কেননা সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। এটা নিশ্চিত যে, তোমার প্রতিপালকের কাছেই সকলকে ফিরে যেতে হবে। তুমি কি দেখেছ সেই ব্যক্তিকে, যে বাধা দেয়। এক বান্দাকে যখন সে নামায পড়ে? আচ্ছা বল তো, সে (অর্থাৎ নামায আদায়কারী) যদি হেদায়েতের উপর থাকে। অথবা তাকওয়ার আদেশ করে (তখন তাকে বাধা দেওয়া কি পথভ্রষ্টতা নয়?)।

আচ্ছা বল তো, সে (বাধাদানকারী) যদি সত্য প্রত্যাখ্যান করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে সে কি জানে না আল্লাহ দেখছেন? খবরদার! সে নিবৃত্ত না হলে আমি তার মাথার অগ্রভাগের চুলগুচ্ছ ধরে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাব। সেই চুলগুচ্ছ, যা মিথ্যাচারী, গুনাহগার। সুতরাং সে ডাকুক তার জলসা-সঙ্গীদের। আমিও ডাকব জাহান্নামের ফেরেশতাদের। সাবধান! তার আনুগত্য করো না এবং সিজদা কর ও নিকটবর্তী হও। 

সূরা আলাকে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে

এই সূরার প্রথম আয়াতগুলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম নাজিল হয়। যখন তিনি হেরা গুহায় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। ফিরিশতা (জিবরীল) তার নিকট এসে বললেন, ‘পড়।’ তিনি বললেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ ফিরিশতা তাকে জড়িয়ে ধরে শক্তভাবে চেপে ধরলেন এবং বললেন, ‘পড়।’ তিনি আবার একই উত্তর দিলেন। এইভাবে ফিরিশতা তিনবার করলেন। 

এরপরের আয়াতে সৃষ্টিজগতের মধ্য থেকে বিশেষ করে মানব সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, মানুষকে ‘আলাক’ থেকে সৃষ্টি করেছেন। ‘আলাক’ হচ্ছে ‘আলাকাহ’ শব্দের বহুবচন। এর মানে জমাট বাঁধা রক্ত। সাধারণভাবে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টির কথা বলার পর বিশেষ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কেমন হীন অবস্থা থেকে তার সৃষ্টিপর্ব শুরু করে তাকে পূর্ণাংগ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন।

মানব সৃষ্টির কথা বর্ণনার পর সূরাতে মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে কলমের মাধ্যমে তথা লেখার শিক্ষা দান করেছেন। তা না হলে মানুষের মধ্যে জ্ঞানের উন্নতি, বংশানুক্রমিক ক্ৰমবিকাশ সম্ভব হত না। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পূর্ববর্তীদের জীবন-কাহিনী, আসমানী-কিতাব সব কিছুই সংরক্ষিত হয়েছে লেখনির মাধ্যমে। কলম না থাকলে, দ্বীন এবং দুনিয়ার কোন কিছুই পূর্ণরূপে গড়ে উঠত না। (ফাতহুল কাদীর)

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা যখন প্রথম সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস, ৩১৯৪, ৭৫৫৩, মুসলিম, হাদিস, ২৭৫১)

হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সেমতে কলম কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে।’ (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৩১৭)

পরের আয়াতে কলমের সাহায্যে যা শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তিনি এমন সব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না। 

এরপরে আল্লাহ তায়ালা মানুষের অবাধ্যতা সূলভ আচরণ নিয়ে কথা বলেছেন। অর্থাৎ দুনিয়ায় ধন-দৌলত, সম্মান-প্রতিপত্তি যা কিছু সে চাইতো তার সবই সে লাভ করেছে। এ দৃশ্য দেখে সে কৃতজ্ঞ হবার পরিবর্তে বরং বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে এবং সীমালঙ্ঘন করতে শুরু করেছে।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, একবার আবু জাহল বলল, যদি মুহাম্মদকে কিবলার দিকে ফিরে সালাত আদায় করতে দেখি তবে আমি অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায় করতে আসলে আবু জাহল তাকে বলল, তোমাকে কি আমি সালাত আদায় করতে নিষেধ করিনি? তোমাকে কি আমি এটা থেকে নিষেধ করিনি? রাসূল তার কাছ থেকে ফিরে আসলেন, আবু জাহলের সাথে তার বিতণ্ডা হলো, তখন আবু জাহল বলল, আমার চেয়ে বড় সভাসদের অধিকারী কি কেউ আছে? তখন আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করলেন যে, ‘সে যেন তার সভাসদদের ডাকে, আমরাও অচিরেই যাবানিয়াদের ডাকব।’ 

ইবনে আব্বাস বলেন, আল্লাহর শপথ, যদি সে তার সভাসদদের ডাকত। তবে অবশ্যই তাকে আল্লাহর যাবানিয়া পাকড়াও করত। (বুখারি, হাদিস, ৪৯৫৮, তিরমিজি, হাদিস, ৩৩৪৯, মুসনাদে আহমাদ, ১/২৫৬, ৩২৯, ৩৬৮)

এরপরে বলা হয়েছে,  দুনিয়ায় সে (মানুষ) যাই কিছু অর্জন করে থাকুক না কেন এবং তার ভিত্তিতে অহংকার ও বিদ্রোহ করতে থাকুক না কেন, অবশেষে তাকে রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে। সেখানে সে অবাধ্যতার কুপরিণাম তখন স্বচক্ষে দেখে নেবে। 

পরের আয়াতে আল্লাহর ইবাদতে বাধাদানকারী আবু জাহেলের কথা বলা হয়েছে যে ইসলামের চরম শত্রু ছিল। পরবর্তীতে বলা হয়েছে, আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে বাধাদানকারী আবু জাহেলের সব কাজকর্ম আল্লাহ তায়ালা দেখছেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর ইবাদত থেকে বাধাদানকারী আবু জাহেলকে আল্লাহ কিভাবে শাস্তি দেবেন তা বর্ণনা করা হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত যে, একদা আবু জাহল বলেছিল যে, ‘যদি মুহাম্মাদ কাবার কাছে নামাজ পড়া থেকে বিরত না হয়, তাহলে আমি তার গর্দানে পা রেখে দেব।’ অর্থাৎ, তাকে পদদলিত করব এবং দস্তরমত লাঞ্ছিত করব। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে এ কথা পৌঁছলে তিনি বললেন, ‘যদি সে তা করত, তাহলে ফিরিশতা তাকে ধরে ফেলতেন।’ (সহিহ বুখারি)

সূরার শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ করা হয়েছে যে, আবু জাহলের কথায় কর্ণপাত করবেন না এবং সেজদা ও সালাতে মশগুল থাকুন। সিজদা করা মানে সালাত আদায় করা। অর্থাৎ হে নবী! আপনি নিৰ্ভয়ে আগের মতো সালাত আদায় করতে থাকুন। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করুন। কারণ, এটাই আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের উপায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বান্দা যখন সেজদায় থাকে, তখন তার পালনকর্তার অধিক নিকটবর্তী হয়। তাই তোমরা সেজদায় বেশী পরিমাণে দোয়া কর।’ (মুসলিম: ৪৮২, আবু দাউদ: ৮৭৫, নাসায়ী: ২/২২৬, মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৭০)

এনটি