দেশে দেশে ইফতার
সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজানুল মোবারক চলছে। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখন আনন্দচিত্তে রোজা পালন করছেন। তবে স্থানের পার্থক্যের কারণে কেউ ১১ ঘণ্টায় রোজা শেষ করছে, কেউ আবার ২২ ঘণ্টাও রাখছে। যে যতক্ষণ রাখুক না কেন, ইফতার কিন্তু সবাই করে। শুধু করেই না, ইফতার নিয়ে থাকে নানা ধরনের আয়োজন ও উৎসব।
প্রতি বছরের ইফতারের আয়োজন অত্যন্ত চমৎকার হয়। তবে গত বছরের মতো এবারের আয়োজনেও ভাটা ফেলেছে করোনা ভাইরাস। বিশ্বের ২০৯টি দেশে দুই লক্ষের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। করোনার ভয়াল থাবা ইফতারির ওপরও বিস্তার করেছে। তারপরও ঘরোয়া আয়োজনগুলোতে ইফতার ঠিকই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে। প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ১৪০ কোটি মুসলমান ইফতারিতে শরিক হয়।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ইফতারের পদ
বাঙ্গালিরা একটু বেশি ভোজি এই কথা আমাদের জানা। কোন খাবার উপকারী কোনটা অনোপাকারী— এই হিসেব বাংলাদেশিরা কখনো করে না। খেজুর, পিঁয়াজু, বেগুনি, হালিম, আলুর চপ, জিলাপি, শরবত, মুড়ি ও ছোলা ছাড়া বাংলাদেশের ইফতারই জমে না। কখনো কখনো এর সঙ্গে পরোটা, মিষ্টি, ফল, খিচুড়ি, ও চিড়ার উপস্থিতিও পাওয়া যায়।
ভারতের একেক রাজ্যে ইফতারির একেক রকম পদ হয়। হায়দরাবাদের লোকজনের ইফতার হয় হালিম দিয়ে। তামিলনাড়ু ও কেরালায় ইফতার হয় ননবো কাঞ্জি দিয়ে। এটি তৈরি হয় ভাত, খাসির মাংস, সবজি ও মসলা দিয়ে। পাশাপাশি থাকে বন্ডা, পাকুড়া- এসব খাবার।
আমাদের পাশ্ববর্তী একেবারে কাছে মুসলিম প্রধানরাষ্ট্র পাকিস্তান। তাদের ইফতার আমাদের মতোই। তাদের ইফতারে যেসব খাদ্যের আধিক্য দেখা যায়- খেজুর, পানি, চিকেন রোল, স্প্রিং রোল, শামি কাবাব এবং ফলের সালাদের পাশাপাশি মিষ্টি ও ঝাল জাতীয় খাদ্য, জিলাপি ও সমুচা, নিমকি। কিছু কিছু অঞ্চলে আমাদের মতো পুরোই বুট মুড়ি বেগুনি ও আলুর চপ থাকে।
লেবানন সুবিধাবঞ্চিত দেশগুলোর অন্যতম। লেবাননীয় ইফতারে থাকে গোসতের কাবাব। আলুর তৈরি ভিন্ন জাতের খাবার। তবে তাদের ইফতারকে সাজাতে দুধ ও মধুর তৈরি বিভিন্ন খাবারও থাকে বেশ।
আলজেরিয়ানরা তাদের ইফতারের প্রধান উপাদান হলো খেজুর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার শরবত ও পনির। তবে গোসতের আইটেম থাকে প্রচুর।
জর্দানে ইফতারের পদ
জর্দানে মুসলমানদের ইফতারে থাকে বিভিন্ন প্রকারের রুটি সঙ্গে পনির ও মিষ্টি হালুয়া। খেজুরও তাদের প্রধান ইফতার। আরো বিভিন্ন ভাজা পোড়াতেও তারা অভ্যস্ত।
ফিলিস্তিনিরা একটি সাহসী জাতি এই রমজান ব্যতীত বিগত সব রমজানগুলো তারা শুরু করতো ইসরাইলী বর্বরতা দিয়ে। প্রতিদিন বছরও ইসরাইল রমজান মাসে ফিলিস্তিনীদের ওপর হামলা করতো। এবার করোনার কারণে পারেনি। ফিলিস্তিনিদের ইফতার আমাদের মতোই। তবে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় পানীয় তামারিন জুস তাদের প্রধান ইফতারে থাকে। গোসতের ভাজাপোড়া থাকে। সঙ্গে দুধ এবং হালুয়াও তাদের ইফতারি সাজায়।
আফ্রিকার দরদি পীড়িত রাষ্ট্র সোমালিয়া। হাজার হাজর বছর ধরে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। সোমালিয়ার ইফতারে থাকে স্থানীয় একধরণের খাবার যা মাছ দিয়ে তৈরি হয়। খেজুর কাবাব পনিরও থাকে।
মিশরীয়রা সবসময়ই সৌখিন। খাবারের আধিক্য তাদের বহুদিনের অভিজাত। সারাদিন রোজার পর তারা সৌখিন যত খাবার আছে সবই রাখে ইফতারির পাতে। তবে কুনাফা ও কাতায়েফ হলো মিসরীদের ইফতারে প্রথম পছন্দ। তবে আটা, চিনি, মধু ও বাদাম দিয়ে তৈরি খাবারও থাকে।
সৌদি আরবের ইফতার মানেই শাহি ইফতার। খেজুরের দেশ সৌদি। ইফাতারের প্রথম পছন্দও খেজুর। তবে এছাড়াও ইফতারের তালিকায় থাকে কুনাফা, ত্রোম্বা, বাছবুচান্ডর নামক নানা রকম হালুয়া, সালাতা (সালাদ), সরবা (স্যুপ), জাবাদি (দই), লাবান, খবুজ (ভারি ছোট রুটি) বা তমিজ (বড় রুটি)। তার একত্রে একসঙ্গে ইফতার করতে পছন্দ করেন। তবে স্থান বা আয়োজনভেদে আরো বহু খাবারা সৌদিয়ানরা প্রস্তুত করে। তবে তাদের একটি বদনাম হলো যতটুকু আয়োজন করে- এর অধিকাংশই নষ্ট করে।
ইরান শিয়া প্রদান রাষ্ট্র। তারাও আমাদের মতোই রোজাসহ রমজানের যাবতীয় আমলগুলো করে থাকে। ইফতারও করে বেশ আয়োজন আর উৎসবের সঙ্গে। তবে এবার করোনার ভয়াবহতায় ইফতার আয়োজন হয়তো একটু ব্যহত হচ্ছে। আপনি যেমন ইফতারের শুরুতে ঠাণ্ডা পানি পান করেন- ইরানীরা করে গরম চা পান। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই তাদের প্রথম পছন্দ। লেভাস বা বারবারি নামের এক ধরনের সুস্বাদু রুটি, পনির, তাজা ভেষজ উদ্ভিদ, মিষ্টি, খেজুর ও হালুয়াও থাকে। হালুয়া ও মধু মিশ্রিত একধরণের তেল দ্বারা রুটিভাজা করে।
অর্থ আর স্বর্ণালঙ্কারের দেশ দুবাই। তদের ইফতার মানেই হলো বিশাল আয়োজন বিশাল খাবারী পশরা। তাদের ইফতারে থাকে দামি দামি গোসতের তৈরি খাবার। গোসতের সঙ্গে রুটি মসুর ডাল ও বিভিন্ন প্রকার সালাত। দুবাইবাসী ইফতারে গোসতকে প্রাধান্য দেয়। শুধুমাত্র ইফতারকে কেন্দ্র করে বড় বড় খাসি ভেড়া দুম্বা বা উট জবাই করে দেয়া তাদের সাধারণ রীতি। তাদের ইফতার বহুক্ষণ চলে। তাদের ইফতার মানেই সন্ধ্যা রাতের খাবার। ইফতারের মজলিস বহুক্ষণ চলতে থাকে। তবে এবার হয়তো ইফতারের এমন আয়োজন হচ্ছে না। হুম! ঘরোয়া পরিবেশে তো হবেই।
আফ্রিকার শেষ সীমান্তে সাগর পাড়ের দেশ মরক্কো। দেশটিতে ইফতারের প্রথম তালিকায় আছে খেজুর, স্যুপ, রুটি। তবে এছাড়াও ভিন্ন হাতের তৈরি খাবার থাকে।
সিরিয়ায় ইফতারের পদ
যুদ্ধ ও ভাগ্য বিড়ম্বিত দেশ হলো সিরিয়া। হালুয়া হলো সিরিয়ার ইফাতারে সবচেয়ে প্রিয় খাবার। হালুয়ার জন্য সারাবিশ্বে সিরিয়ার ভিন্ন একটি সুনাম রয়েছে। প্রায় হাজার প্রকারের হালুয়া থাকে সিরিয়ার বাজারে বাজারে। ঘরেও তৈরি হয়। ইফতারের হালুয়াতে থাকে মধু ওখেজুর। স্থানীয়দের তৈরি দিজাজ সয়াইয়া খবুজ সরবাও থাকে।
অটোমান সাম্রাজ্যের দেশ তুরস্ক। সেই সঙ্গে আরেকটি কথা- কাবাবের আদিবাড়ী নাকি তুরস্ক। তাই তুর্কিরা তাদের ইফতারের প্রধান তালিকায় রাখেন হরেক জাতীয় কাবাব। তবে শরবতের উপস্থিতিও উল্লেখ করার মতো।
মালদ্বীপের ইফতার
এখানে ইফতার ‘রোয়াদা ভিলান’ নামে পরিচিত। তাদের ইফতারের মূল উপাদান শুকনো বা ফ্রেশ খেজুর। বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ বা হোটেলে ইফতার ও ডিনারের বিশেষ আয়োজন থাকে। অন্যদিকে সেখানকার মসজিদগুলোতে ফ্রি খেজুর জুসের ব্যবস্থা করা হয়।
এখানে ইফতার আয়োজনে খেজুর ও অন্য ফল রাখা হয়। এরপর স্যুপ, রুটি ও বিভিন্ন স্থানীয় খাবারের আয়োজন তো রয়েছেই। রাশিয়ান ঐতিহ্যবাহী কাভাসকেও তৃষ্ণা মেটাতে সেরা পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আফগানিস্তানে ইফতার
গরু বা খাসির মাংসের কাবাব, হরেক রকম ফ্রেশ ও শুকনো ফল এবং জুস এ অঞ্চলের ইফতার টেবিলের মধ্যমণি।
আখের জন্য নাকি মালয়েশিয়া বিখ্যাত, তাই তাদের ইফতারে থাকে আখের রস। আরো থাকে সয়াবিন মিল্ক, যাকে তাদের ভাষায় বারবুকা পুয়াসা বলা হয়। লেমাক লাঞ্জা, আয়াম পেরিক, নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস ও অন্যান্য খাবারও থাকে পর্যাপ্ত।
আমেরিকার ইফতারের পদ
আমরিকায় খ্রিস্টান রাষ্ট্র হলেও ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মুসলমান আছে। আমরিকা ইফতারিতে আরবীয় স্টাইল। যেমন- খেজুর, খুরমা, সালাদ, পনির বাধ্যতামূলক। তবে রুটি, ডিম, গোশত, ইয়োগার্ট, হট বিনস, স্যুপ, চা ইত্যাদিও থাকে।
দ্বীপ রাষ্ট্র অস্ট্রিলিয়া। সেখানেও আছে মুসলমান। অস্ট্রেলিয়া যা দিয়ে ইফতার করে আমরা এগুলো মাঝে মাঝে খাই। স্যান্ডউইচ, পনির, মাখন, দুগ্ধজাতীয় খাবার, নানাবিধ ফল ও ফলের রস খাওয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইফতার
এখানকার মুসলমানদের ইফতারের প্রথম পছন্দ হলো নুডলস, স্যুপ, ফলের রস, বিভিন্ন প্রকারের ফলফলাদি।
সাগর তীরবর্তী দেশ পর্তুগাল। তাদের ইফতারের তালিকা প্রধান হলো এক প্রকার কেক যার নাম পাস্টার দি নাতা ও সারডিন মাছের কোপ্তা বেশ পছন্দ করেন তারা। এ ছাড়া রয়েছে প্রেগোরোজ, ট্রিনচেডো, প্রাউজ (চিংড়ি), স্প্রিং গ্রিল ও স্যুপ।
ব্রিটেনে ইফতারের পদ
রানি এলিজাবেদের দেশ ব্রিটেন। ব্রিটেনের ইফতারিতে আহামরির কিছু নেই। যা কিছু আছে দেখুন- খেজুর, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, মাংস, চা-কফি দিয়ে ইফতার।
করোনার আক্রমণে আজ ইতালি বিধ্বস্ত চৌচির। ইতালি মোট মুসলমানদের সংখ্যা ২৮ লাখের উপরে। ইতালীয় মুসলিমরা ইফতার করে ইউরোপীয় স্টাইলে। ইউরোপীয় যত খাবার আছে সবই রাখা হয়। যেমন- বার্গারজাতীয় খাদ্য, মাল্টা, আপেল, আঙুর, বিভিন্ন ফলের রস ইত্যাদি। তবে গোসতের বিভিন্ন প্রকার ভাজাপোড়াও থাকে।
কানাডার ইফতারের পদ
কানাডায় মোট জনসংখ্যার ৩.২% মুসলমান। সেই হিসেবে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ ৪৮ হাজারের মতো। কানাডীয় মুসলমানরা সাধারণত আরবীয়দের মতো ইফতারে খেজুরকে প্রাধান্য দেয়। খেজুর খুরমা পনির সালাদ বিভিন্ন স্যুপও ইফতারির প্লাটে থাকে।
ফুটবলের দেশ বলা হয় স্পেনকে। স্প্যানিশ মুসলমানরা ইফতার করেন হালাল শরমা, ডোনার কাবাব, হামাস (যা তেরি করা হয় ছোলা, তিল, জলপাই তেল, লেবু, রসুন ইত্যাদি দিয়ে। এটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের খাবার), লাম্ব কোফতা, আলা তুরকা, পাইন অ্যাপেল, টমেটো সালাদ।
জাপানের ইফতারের পদ
জাপানের মুসলমানদের ইফতারি আইটেমে রয়েছে জুস, স্যুপ ও মাশি মালফুফ, যা আঙুর, বাঁধাকপির পাতা ও চাল মিশিয়ে বানানো এক প্রকার খাদ্যৗ। এছাড়াও গোসতের অনেক আইটেম থাকে।